জনজীবন: (১) ছাতা মাথায় দিয়ে খিদিরপুরের রাস্তায় মোবাইলে চোখ স্থানীয়দের। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক, সুমন বল্লভ
পরশু থেকেই ওয়ার্ডের নিজস্ব গ্রুপে প্রচার শুরু হয়েছিল— ‘কোনও রকম গুজবে কান দেবেন না। প্ররোচনায় পা দেবেন না।’
তখনও অবশ্য কেউ জানতেন না যে, শনিবারই বেরোবে অযোধ্যা মামলার রায়। কিন্তু প্রস্তুতি হিসেবে কিছুটা আগে থেকেই সতর্কতামূলক প্রচার শুরু হয়ে গিয়েছিল গার্ডেনরিচ এলাকায়। শুক্রবার রাতে জানা যায় যে, পরদিনই আসছে রায়। তখন আর হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের উপরে ভরসা রাখতে পারেননি এলাকার বাসিন্দারা। ছোট ছোট দল গড়ে বেরিয়ে
পড়েছিলেন প্রচারে।
কলকাতা পুরসভার ১৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আখতারি নিজামি শাহজাদার ছেলে ববি শাহজাদা বললেন, ‘‘আমাদের ওয়ার্ডের একটা গ্রুপ রয়েছে। সেখানে এলাকার নবীন প্রজন্মকেই মূলত রাখা হয়েছে। সেখানে পুরসভার কাজ কেমন হচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু গত দু’দিন সেখানে রায় নিয়েই আলোচনা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের রায় যা-ই হোক, আমাদের শান্তি বজায় রাখতে হবে, তা বলা হয়েছে বারবার।’’ ববির মা আখতারি বলছেন, ‘‘আগামী দু’দিন আমরা এলাকায় নজর রাখব। পরিস্থিতি কেমন, তা দেখতে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে এলাকায় এলাকায় ঘুরব।’’
শুধু আখতারির ওয়ার্ডেই নয়, এ দিন গার্ডেনরিচের অন্যত্রও ছবিটা মোটামুটি এমনই। বৃষ্টিতে যাঁরা বাড়িতে ছিলেন, তাঁরা টিভি দেখে রায় নিয়ে নিজেদের মধ্যেই আলোচনা করেছেন। কিন্তু কোনও পক্ষই বাড়তি কোনও উচ্ছ্বাস বা ক্ষোভ দেখাননি। বরং গার্ডেনরিচে এই দিনটা ছিল বাকি আর পাঁচটা দিনের মতোই। না কি ছিল না? অযোধ্যা মামলার রায় নয়, এ দিন বরং সেখানে অনেক বেশি আলোচনা হয়েছে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল নিয়ে! বুলবুল কখন আসবে, তাতে কী হতে পারে, তা নিয়ে সংশয় ছিল সকলের মনে। যেমন গার্ডেনরিচ রোডে আটার দোকানের মালিক মহম্মদ রফিকুল বলছেন, ‘‘রায় নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায়? বৃষ্টি হলে আটা বিক্রি হবে না। সেটাই বেশি চিন্তার।’’
জনজীবন: রায় ঘোষণার পরে নাখোদা মসজিদের সামনের রাস্তা। শনিবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক, সুমন বল্লভ
পাহাড়পুর রোডের রিকশাচালক আমিরুদ্দিন আবার বলছেন, ‘‘অযোধ্যা-অযোধ্যা সকলে বলছে শুনছি। আর কিছু জানি না। বেশি বৃষ্টি হলে খদ্দের পাব কি না, তাই ভেবে যাচ্ছি সকাল থেকে। আমাদের তো দিনের রোজগার।’’ আমিরুদ্দিনের সুরেই স্থানীয় দোকানকর্মী অসীম পাত্র বলেছেন , ‘‘এলাকা নিয়ে অশান্তির ভয় অন্যরা করে। আমরা কিন্তু এ সব টের পাই না।’’ ফতেপুরের বাসিন্দা নুরুল হকের মন্তব্য, ‘‘বহু বছর ধরে একটা বিষয় নিয়ে অশান্তি ছিল। অন্তত তা থেকে তো মুক্তি মিলবে এ বার।’’
১৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা ১৫ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান রণজিৎ শীল সকালে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলেন। বললেন, ‘‘রায় যা-ই হোক না কেন, শান্তি বজায় রাখার আবেদন করেছি।’’ ‘স্পর্শকাতর’ এলাকা, তাই কোনওরকম উত্তেজক পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, তাই বৃহস্পতিবারই স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন মেটিয়াবুরুজ এলাকার কাউন্সিলর শামস ইকবাল। আর শনিবার রায় বেরোবে জানার পরে শুক্রবার রাত থেকেই বাড়িতে বাড়িতে প্রচার চালিয়েছেন। ওই এলাকার বাসিন্দা দানেশ শেখের কথায়, ‘‘রায় নিয়ে তো দু’দিনের আলোচনা। আগে তো পেটের চিন্তা করতে হবে আমাদের।’’
প্রচারের ফাঁকে রাজাবাজার এলাকার কাউন্সিলর সোমা চৌধুরী বললেন, ‘‘অযোধ্যার রায় তো আছেই। কিন্তু বুলবুলের প্রভাব আমাদের জীবনে অনেক বেশি। তাই দু’টো বিষয়েই সচেতন থাকার জন্য মাইকে প্রচার করছি।’’ রাজাবাজারের বাসিন্দা সাবির আহমেদের কাপড়ের পৈতৃক ব্যবসা রয়েছে। তিনি বললেন, ‘‘আমাদের অনেক মুসলিম কর্মী আছেন, তাঁদের কিন্তু এ ব্যাপারে কোনও উৎসাহ নেই যে, রায় কী হচ্ছে বা হবে। বেশির ভাগ লোকই নিজের রুজি-রোজগার নিয়ে ব্যস্ত।’’ মমিনপুরের বাসিন্দা সফিকুল কিংবা অনিল পাত্ররা বলেছেন, ‘‘এটা তো খেলা নয় যে এক পক্ষ জিতল, আরেক পক্ষ হারল। কেউই যাতে বিষয়টাকে সে ভাবে না দেখেন, তার চেষ্টা আমাদের সবাইকেই করতে হবে।’’
শান্তি-সম্প্রীতি বজায় রাখতে আবেদন করছেন নাখোদা মসজিক কর্তৃপক্ষও। মসজিদে আসা সকলকেই শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে। মসজিদের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য মহম্মদ কাসিমের কথায়, ‘‘একটা কথা সকলকে মাথায় রাখতে হবে যে, অন্য কেউ নয়, এই রায় দিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ফলে এক জন নাগরিক হিসেবে সে রায় আমাদের সকলকেই মানতে হবে। এখানে হার-জিতের কোনও প্রশ্নই নেই। বরং রায় বেরোনোর পরে শান্তি বজায় থাকলে সেটাই সকলের জয়। দেশের জয়।’’ ম্যানেজিং কমিটির আর এক সদস্য বলছেন, ‘‘এক ৬ ডিসেম্বরের ঘটনার যাতে আর এক ৯ নভেম্বরে পুনরাবৃত্তি না হয়, তাই এ বার সতর্ক সকলেই। মানুষের মতো দেশকেও তো ক্রমশ পরিণত হতে হয়। কতটা পরিণত হল, রায় বেরোনোর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ হয়তো তারই পরীক্ষা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy