Advertisement
E-Paper

একের কর্তব্য পালনে রক্ষা পায় অন্য জনের জীবন, বুঝিয়ে দিয়ে গেল আমার ছেলে

সব উত্তরই ঝাপসা। কোনও দিন উত্তর পাব না। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছেলেটার মুখ। বিয়ের বেশ কিছু বছর বাদে ওকে কোলে পেয়েছিলাম আমরা।

Mother shares her tragic story after losing her son in the road accident

ছেলে সৌরনীলের ছবির সামনে মা দীপিকা সরকার। —নিজস্ব চিত্র।

দীপিকা সরকার

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০২৩ ০৬:০২
Share
Save

দায়িত্ব-কর্তব্য পালন ছাড়া কি অধিকার সুরক্ষিত হয়? অধিকার না থাকলে স্বাধীনতাই বা কোথায়? অন্যেরা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বলেই কি পথে বেরিয়ে বাঁচার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে আমার সাত বছরের ছেলেটা? সেই কারণেই কি ওকে পিষে দিয়ে চলে গিয়েছিল লরি?

সব উত্তরই ঝাপসা। কোনও দিন উত্তর পাব না। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছেলেটার মুখ। বিয়ের বেশ কিছু বছর বাদে ওকে কোলে পেয়েছিলাম আমরা। কয়েক বছর ঘর করার পরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কত কথাই বা থাকতে পারে? কিন্তু ওকে পেয়েই সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিল আমাদের জীবন।

দমদম ক্যান্টনমেন্টে আমার বাবা-মায়ের বাড়ি। সম্বন্ধ করে হরিদেবপুরের বাসিন্দা সরোজকুমার সরকারের সঙ্গে বিয়ে হয়। সরোজের মুদির দোকান রয়েছে। বিয়ের পরে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছেলে-মেয়েদের একটি স্কুলে কাজে ঢুকি। তার জন্য একাধিক প্রশিক্ষণও নিই। সৌরনীলের জন্ম হতেই ওকে বড় করার ব্যস্ততায় কাজটা ছেড়ে দিই। না-হলে কে দেখবে ওকে! প্রতিদিন ভোরে স্কুলে যেত। সাড়ে দশটায় বাড়ি ফিরে খেয়েই আবার পড়তে বসত। কখনও শুনিনি, পড়বে না বলে বায়না করছে। উল্টে কোনও পরীক্ষায় সামান্য কম নম্বর পেলেই মুখ হাঁড়ি হয়ে থাকত। আমি আর ওর বাবা তখন মন ভাল করার চেষ্টা করতাম। ডিম, মেটের তরকারি আর কচুরি ওর প্রিয় খাবার। গাড়ি নিয়ে খেলতেও খুব ভালবাসত। এগুলো দিয়েই ভোলানোর চেষ্টা করতাম আমরা।

ওর হাতের কাজও ছিল দেখার মতো। ১৫ অগস্ট এলে নিজেই পতাকা তৈরি করত সৌরনীল। শুরুর দিকে প্লাস্টিকের পতাকা কিনে দেওয়ার বায়না ধরত। ছাদে সেগুলো লাগাত। ধীরে ধীরে আঁকার খাতায় পতাকা আঁকতে শুরু করে। সেগুলিই ঘরের জানলার শিকে লাগাত। এ বছর কাপড়ে এঁকে পতাকা তৈরি করার পরিকল্পনা ছিল ওর। বলত, বড় হয়ে পাইলট হতে চায়। খরচের কারণে ইং‌রেজি মাধ্যম স্কুলে দিতে পারিনি। কিন্তু ইংরেজি পড়ানোয় জোর দিতাম। ওকে বলেছিলাম, পাইলট হওয়ার মতো করে নিজেকে তৈরি করলে বাড়িঘর বিক্রি করেও পড়াতে রাজি আমরা। সেই স্বপ্ন আর পূরণ হবে না।

ভাবছি, ওকে ছাড়া কী করে জীবনটা কাটবে? ওর বাবার পায়ের উপর দিয়ে সে দিন লরির চাকা চলে গিয়েছিল। এখনও তিনি এসএসকেএমে ভর্তি। তিনশোর উপরে সুগার। চিকিৎসকেরা ইনসুলিন দিয়ে কোনও মতে সুগার কমিয়ে দুর্ঘটনার চার দিন পরে অস্ত্রোপচার করেন। বাঁ পায়ের ঊরুর কাছে প্লেট বসেছে। সর্বক্ষণ ঘোরের মধ্যে আছেন। মানসিক ভাবেও অসুস্থ এখন। না খেয়েও বলছেন, খেয়েছেন। কখনও বলছেন, অস্ত্রোপচার অর্ধেক হয়েছে। নিজেই নাকি ডাক্তারদের বারণ করে দিয়েছেন। এই অবস্থায় কবে ছাড়বে, জানি না।

আমার স্বামী আর দোকানে বসতে পারবেন কি না, তা-ও অনিশ্চিত। আমার একটা কাজের ব্যবস্থা না হলে পরিবারের খরচ কী করে চলবে, জানি না। কয়েক দিনের মধ্যেই কাজের খোঁজে বেরোতে হবে। সেই ডায়মন্ড হারবার রোড পেরিয়েই চলতে হবে। আমার ছেলের মতো অন্য কারও সঙ্গে যেন এ রকম না হয়। পুলিশ, পথচারী, গাড়িচালক, অভিভাবক— সকলেই নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য মনে রাখুন।

ছেলের শেষকৃত্যের সময়ে ওর বড়মামার কান্না কানে বাজে। এই তো কয়েক বছর আগের কথা। অন্নপ্রাশনের দিন ছেলের মুখে সন্দেশ দিয়েছিলেন আমার এই দাদা। সেই ছেলেকেই কবরে শুয়ে থাকা অবস্থায় মুখে সন্দেশ গুঁজে দিতে হয়েছে দাদাকেই।

(লেখিকা দুর্ঘটনায় মৃত স্কুলপড়ুয়া সৌরনীলের মা)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Road Accident Behala Tragedy Death

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}