Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
অভিযুক্ত বেসরকারি হাসপাতাল

টাকা গেল, ‘অবহেলা’য় প্রাণও গেল

হাসপাতাল থেকে রোগীকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পরে জানা গেল, তাঁর সেপ্টিসেমিয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, হাসপাতালে থাকাকালীনই তাঁর স্ট্রোকের কিছু লক্ষণ ছিল। অভিযোগ, বাড়ির লোকজনকে সে বিষয়ে বিন্দুবিসর্গ জানানো হয়নি।

বিভূতিরঞ্জন চন্দ

বিভূতিরঞ্জন চন্দ

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:২০
Share: Save:

হাসপাতাল থেকে রোগীকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পরে জানা গেল, তাঁর সেপ্টিসেমিয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, হাসপাতালে থাকাকালীনই তাঁর স্ট্রোকের কিছু লক্ষণ ছিল। অভিযোগ, বাড়ির লোকজনকে সে বিষয়ে বিন্দুবিসর্গ জানানো হয়নি। বাড়ি ফেরার দিন কয়েকের মধ্যেই ফের তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে এই তথ্যগুলি সামনে আসে তাঁদের। এর পরেই মৃত্যু হয় রোগীর। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর এবং মেডিক্যাল কাউন্সিলের কাছে মৃতের পরিবারের প্রশ্ন, রোগীর পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তাঁর বাড়ির লোককে না জানিয়েই তাঁকে ছুটি দেওয়া কি শঠতা নয়? যেখানে বিপুল খরচ করে তাঁরা চিকিৎসার জন্য নিয়ে এসেছিলেন, সেখানে পরিস্থিতি খারাপ জেনেও তাঁকে ছেড়ে দেওয়া কি আদতে দায় এড়ানো নয়? কেন রোগীর ডিসচার্জ সার্টিফিকেটে তাঁর সেপ্টিসেমিয়া, কিডনি ফেলিওর কিংবা বেডসোর-এর কথা লেখা হয়নি, সেই প্রশ্ন তুলে হাসপাতালের বিরুদ্ধে তথ্য গোপনের অভিযোগও এনেছেন তাঁরা।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগগুলির প্রায় কোনওটিই মানতে চাননি। তাঁদের দাবি, হাসপাতাল থেকে যখন রোগীকে ছাড়া হয়, তখন সেপ্টিসেমিয়া বা অন্য উপসর্গের প্রমাণ তাঁরা কোনও পরীক্ষায় পাননি। তাই ডিসচার্জ সার্টিফিকেটে সেগুলির উল্লেখ থাকার কথা নয়।

রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর এবং মেডিক্যাল কাউন্সিল অবশ্য জানিয়েছে, ইদানীং তাদের কাছে এমন অভিযোগের সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, বেসরকারি হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে একের পর এক এমন অভিযোগে তিতিবিরক্ত নবান্নের শীর্ষ স্তরও। নানা ফিকিরে রোগীদের থেকে বাড়তি টাকা আদায়, পাঁচতারা হোটেলের মতো ঝাঁ চকচকে ঘরে ভর্তি রেখে চিকিৎসায় অবহেলা করা, কার্যত প্রয়োজন ছাড়াই হাজারো পরীক্ষানিরীক্ষা এমনকী অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করা, এক রকম প্যাকেজ বলে ভর্তি করে নানা ছলে তার চেয়ে বেশি টাকা আদায়-সহ নানা অভিযোগ নিত্য জমা পড়ছে স্বাস্থ্য দফতরে। কী ভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায়, সে ব্যাপারে স্বাস্থ্যকর্তাদের ভাবনাচিন্তা করতে বলেছে রাজ্যের শীর্ষ প্রশাসন।

একই ভাবে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের এক কর্তা বলেন, ‘‘বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গেলে জলের মতো টাকা খরচ হয়ে যায়। কিন্তু অধিকাংশ রোগীরই অভিযোগ, পরিস্থিতি হাতের বাইরে গেলে চিকিৎসকেরা বহু ক্ষেত্রে দায় এ়ড়াতে চান। এটা যে কোনও ভাবে বন্ধ করা দরকার।’’

দমদমের বাসিন্দা, ৭৫ বছরের বিভূতিরঞ্জন চন্দকে গত ১০ ডিসেম্বর ই এম বাইপাসের আর এন টেগোর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ২২ ডিসেম্বর তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয়। তাঁর মেয়ে সুমনা চৌধুরীর অভিযোগ, ওই ক’দিন হাসপাতালে থেকে তাঁর বাবার অবস্থার উন্নতি তো দূরের কথা, বরং অবনতি হয়েছে। তা-ও তাঁকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। বাড়ি ফেরার পরে তাঁরা বুঝতে পারেন, এই রোগীকে বাড়িতে রাখা যাবে না। ২৫ ডিসেম্বর তাঁকে অন্য একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আর তখনই পরীক্ষায় ধরা পড়ে, তিনি সেপ্টিসেমিয়ায় আক্রান্ত। সুমনা বলেন, ‘‘আগের হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন ১৭ বা ১৮ তারিখে আমরা হঠাৎই দেখি, বাবার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। অসংলগ্ন কথা বলছেন। ডাক্তারকে সে কথা বলায় তাঁরা জানিয়েছিলেন, ওষুধের কারণে বেশি ঘুম হচ্ছে। হয়তো সেই কারণেই কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। পরে কিন্তু
আমরা জানতে পারি, ওই সময়ে বাবার স্ট্রোক হয়েছিল।’’

সুমনার অভিযোগ, আর এন টেগোর হাসপাতালে তাঁর বাবার চিকিৎসার জন্য খরচ হয়েছে ৯০ হাজার টাকা। কিন্তু তার পরেও ন্যূনতম যত্ন বা পরিষেবা পাননি তিনি। তাই তাঁর বে়ডসোর ভয়াবহ আকার নিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘‘বেসরকারি হাসপাতালে বিপুল টাকা খরচ করে সাধারণ মানুষ যখন চিকিৎসা করাতে আসেন, তখন তাঁদের আশা থাকে, সেখানে রোগী যথাযথ চিকিৎসা এবং ডাক্তার-নার্সদের যথাযথ মনোযোগ পাবেন। কিন্তু পরিবর্তে যে অবহেলার শিকার আমার বাবাকে হতে হয়েছে, তাতে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল ও ডাক্তারদের উপর থেকে আমাদের আস্থা-ভরসা উঠে গিয়েছে।’’

হাসপাতালের মেডিক্যাল সুপার জয়দীপ মুখোপাধ্যায় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘বিভূতিবাবুর হার্টের বড়সড় সমস্যা ছিল। ডায়াবিটিস, হাইপারটেনশনও ছিল। ওই বয়সে ক্ষয়জনিত কিছু পরিবর্তন আসে। ওঁরও সেটাই হয়েছিল। স্ট্রোক হওয়ার বিষয়টা ঠিক নয়।’’ আর সেপ্টিসেমিয়া? তিনি বলেন, ‘‘না, আমরা সে রকম কিছু জানতাম না।’’ যদিও সুমনাদেবীর কাছে তাঁর বাবার যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট রয়েছে, তাতে সেপ্টিসেমিয়াই ধরা পড়েছে বলে বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন। আর ওই পরিবর্তন রাতারাতি হওয়া সম্ভব নয় বলেই তাঁদের অভিমত।

বেডসোর-এর কথা অবশ্য মেনে নিয়েছেন জয়দীপবাবু। তিনি জানান, তাঁদের ডাক্তারেরা বিষয়টি দেখেছিলেন এবং কী কী ওষুধ লাগাতে হবে, সেটাও তাঁরা বলে দিয়েছিলেন। প্রশ্ন উঠেছে, যে রোগী বাড়িতে হাঁটাচলা করতেন এবং বেডসোরের কোনও চিহ্ন ছিল না, মাত্র ১২ দিন হাসপাতালে ভর্তি থেকে কী ভাবে তাঁর বে়ডসোর হতে পারে? তা হলে কি হাসপাতালে তাঁর কোনও পরিচর্যাই হয়নি?

এই বিষয়টিতে সরব হয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারাও। তাঁদের বক্তব্য, সরকারি হাসপাতালে রোগীর বিপুল চাপের মধ্যে বহু সময়েই নার্সদের পক্ষে যথাযথ পরিচর্য়ায় কিছু ঘাটতি থেকে যায়। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালে হাজার হাজার টাকা খরচের পরেও এই ধরনের অবহেলা মেনে নেওয়া সত্যিই কঠিন। বিষয়টির যথাযথ তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন তাঁরা।

অন্য বিষয়গুলি:

Government Hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy