কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সাম্বিয়াকে নিয়ে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে ঢুকছে পুলিশের গাড়ি। রবিবার। ছবি :সুদীপ্ত ভৌমিক।
ময়দানের তাজা ঘটনার ঘনচক্কর তো আছেই। সেই সঙ্গে মহম্মদ সোহরাবের উপরে এসে পড়ছে তাজ মহম্মদকে খুনের মামলার তামাদি হতে বসা কালো ছায়া। সেই তাজ, এক যুগেরও বেশি আগে ফলপট্টিতে যিনি ছিলেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী।
গাড়িশাল তখনও গড়ে ওঠেনি সোহরাবের। দামি, অন্যের চোখ টানে, এমন গাড়ি হয়নি একটাও। তবে একটা টাটা সুমো ছিল। আর সেই গাড়িটাই ভাঙচুর করেছিল উত্তেজিত জনতা।
কেন?
ফলমান্ডির অন্যতম বড় ব্যবসায়ী তাজ মহম্মদ খুন হওয়ার অব্যবহিত পরে ক্ষিপ্ত জনতার ক্ষোভ আর উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ ছিল সেটা। ঘটনাটি ২০০২-এর ডিসেম্বরের।
তার প্রায় ১৩ বছর পরে, ২০১৬-র ১৩ জানুয়ারি সেই সোহরাবেরই ছোট ছেলে সাম্বিয়ার বিরুদ্ধে বিলাসবহুল অডি গাড়ি নিয়ে বায়ুসেনার এক অফিসারকে পিষে মারার অভিযোগ উঠেছে। এবং এখানে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠছে সোহরাবের বিরুদ্ধেও।
ছেলের ঘাতক গাড়ি নিয়ে এই ভাবে সোহরাব যখন কোণঠাসা, তখন পুরনো সেই খুনের মামলার ফাইল যাতে ‘ক্লোজ্ড’ বা বন্ধ না-হয়, সেই জন্য তৎপর হয়েছেন নিহতের আত্মীয়েরা। ফাইল ক্লোজ্ড হয়ে গেল তাজ মহম্মদকে খুনের ঘটনার তদন্ত পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে।
১৩ বছরেও সেই খুনের কিনারা করতে পারেনি লালবাজার। কলকাতা পুলিশ মামলাটি বন্ধ বা ‘ক্লোজ’ করতে চেয়ে আদালতে আবেদন করেছে। কিন্তু তাজের পরিবারের তরফে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে পাল্টা রিট আবেদনে বলা হয়েছে, তদন্তে পুলিশ এগোতে পারল না কেন, সেটা পুলিশকে জানাতে হবে।
২০০২-এর ২৫ ডিসেম্বর বিকেলে জোড়াসাঁকোর বল্লভদাস স্ট্রিটে নিজের তেতলার অফিসে খুন হন তাজ। শুধু তাঁর মাথা ও মুখেই ছিল ধারালো অস্ত্রের অন্তত ২৯টি কোপের চিহ্ন। গুলিও করা হয়েছিল তাজকে।
কিন্তু খুনের মামলা রুজু করা হয়েছিল অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীদের বিরুদ্ধে। সোহরাবের নাম অভিযুক্তের তালিকায় ছিল না। তা হলে এখন সোহরাবের বেকায়দায় পড়ার সঙ্গে তাজ-হত্যা মামলায় নতুন গতি আনার উদ্যোগের সম্পর্ক কী?
গোয়েন্দা বিভাগ সূত্রের খবর, তদন্ত চলাকালীন প্রথম প্রথম তাজের বাড়ির লোকজন জোর দিয়ে বলতেন, এই খুনের পিছনে সোহরাবই আছেন বলে সন্দেহ করছেন তাঁরা। কিন্তু ক্রমশ তাঁরা তাঁদের বয়ান থেকে পিছু হটতে থাকেন। এক আত্মীয়ের মন্তব্য, ‘‘তত দিনে ফলমান্ডিতে সোহরাবের দাপট শুরু হয়ে গিয়েছে। তাজ খুন হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই মেছুয়ায় নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় সোহরাবের। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, ওর সঙ্গে এঁটে ওঠা সম্ভব ছিল না।’’
সেই সময়ে বিষয়টির খোঁজখবর করতে নামা এক পুলিশ অফিসার জানান, তাজের আততায়ী ছিল দু’জন। তাদের মধ্যে সম্ভবত এক জনকে চিনতেন তাজ। দুই আগন্তুক বড়দিনের বিকেলে তাজের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। তাজ তাদের তেতলার অফিসঘরে ডেকে নিয়ে এক কর্মীকে বরফি-লাড্ডু আনতে দেন। তাজ যে ওই দু’জনের এক জনকে অন্তত চিনতেন, অফিসে ডেকে মিষ্টি আনিয়ে আপ্যায়নই তার প্রমাণ।
ওই অফিসারের কথায়, ‘‘এক ব্যক্তি তাজ মহম্মদের অফিসের গায়ে দাঁড়িয়ে ডাব বেচতেন। সেই ডাব বিক্রেতা জানান, ওই দুই আগন্তুককে তিনি সে-দিন তাজের অফিসে ঢুকতে-বেরোতে দেখেছিলেন। তিনি আরও দেখেন, অন্য এক ব্যক্তি নিজের মোটরবাইকের পিছনে ওই দু’জনকে বসিয়ে রবীন্দ্র সরণি ধরে চিৎপুরের দিকে যাচ্ছে।’’ তৃতীয় ব্যক্তিটি সোহরাব কি না, তখন প্রশ্ন তুলেছিলেন তাজের আত্মীয়স্বজন। কিন্তু লালবাজার মোটেই গা করেনি বলে অভিযোগ তাজের আত্মীয়দের। পুলিশি সূত্রের খবর, তত দিনে পুলিশের একাংশ তো বটেই, সেই সঙ্গে তদানীন্তন শাসক বামফ্রন্টের কোনও কোনও প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে সোহরাবের ঘনিষ্ঠতা হয়েছে।
গোয়েন্দাদের একটি সূত্রের মতে, তাজকে এমনই নৃশংস ভাবে খুন করা হয়, যেটা ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটানোর সাক্ষ্য দিচ্ছে। পুলিশ এবং মেছুয়ার ফল ব্যবসায়ীদের একাংশের বক্তব্য, রেড রোডে গাড়ির ধাক্কায় জওয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় সোহরাবের কোণঠাসা হয়ে পড়ার ব্যাপারটা ওই পুরনো মামলা বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে কিছুটা অক্সিজেন জোগাবে তাজের পরিবারকে। একদা বাম শিবিরের সঙ্গে সোহরাবের দহরম-মহরম থাকলেও রাজনৈতিক পালাবদলের পরে শাসক তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর মাখামাখির অভিযোগ উঠছিল। যদিও তৃণমূলের মহাসচিব ও শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় শনিবারেই জানিয়ে দিয়েছেন, সোহরাব তাঁদের দলের কেউ নন। তাঁর সঙ্গে পার্থবাবুদের দলেরও কোনও সম্পর্ক নেই।
তৃণমূলের সঙ্গে সোহরাবের সম্পর্ক থাক বা না-থাক, তাজ-হত্যায় সোহরাবের জড়িত থাকার অভিযোগ তাঁর প্রবল প্রতাপের জন্যই গিলে ফেলতে বাধ্য হয়েছিল নিহতের পরিবার। এখন সোহরাব প্যাঁচে পড়ায় তাজের আত্মীয়স্বজন মনে কিছুটা জোর পাচ্ছেন এবং প্রিয়জনকে হারানোর একটা হেস্তনেস্ত চাওয়ার সাহস দেখাতে পারছেন। তাজের ভাই খুরশিদ আলম ওরফে পাণ্ডে বলছেন, ‘‘খুনিরা ফলমান্ডির গলিঘুঁজি চিনত। খুনের করার পরে ওরা ভিড়ে মিশে যায়।’’ মামলা বন্ধ করার জন্য আদালতের অনুমোদন জোগাড় করে পুলিশ যাতে হাত ধুয়ে ফেলতে না-পারে, সেটাই নিশ্চিত করতে চাইছেন খুরশিদেরা। তাঁর আইনজীবী সৈয়দ শাহিদ ইমাম বলেন, ‘‘আমরা চাই, আদালতে হাজির হয়ে পুলিশ বিবৃতি দিয়ে জানাক, তাজ-হত্যার তদন্ত এই মুহূর্তে কোথায় দাঁড়িয়ে।’’
কোথায় দাঁড়িয়ে ওই তদন্ত?
‘‘অনেক দিন আগের ঘটনা। তদন্তে কত দূর কী হয়েছে, খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে,’’ বলছেন গোয়েন্দা-প্রধান দেবাশিস বড়াল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy