সুখটানে কলকাতার মেয়র। শুক্রবার। — নিজস্ব চিত্র
প্রকাশ্যে তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি এবং পাবলিক প্লেসে ধূমপান— আইনত দুই-ই নিষিদ্ধ। অথচ তারই ফাঁকফোঁকর গলে কলকাতা জুড়ে দিব্যি দুটোই চলছে। আটকানোর পথ নেই। এর মধ্যেই শহরকে ‘স্মোক-ফ্রি’ করার সদিচ্ছা প্রকাশ করেছেন খোদ মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গে জানিয়েছেন, তিনি নিজে চেন স্মোকার। কলকাতাকে তামাকমুক্ত করা যাবে? মেয়রের দাবি, ‘‘মানুষ চেষ্টা করলে ঠিক পারবেন। ৫৩ বছর বয়সে আমি ১৩৭ বার চেষ্টা করেছি, পারিনি। এ বার ফের চেষ্টা করব।’’ অনেকেরই প্রশ্ন, যেখানে মেয়র নিজেই এখনও ধূমপান বন্ধ করতে পারেননি, সেখানে তাঁর সদিচ্ছার পরিণতি কত দূর হবে?
ইতিমধ্যেই কলকাতা পুরসভা চত্বরকে তামাকবর্জিত এলাকা হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ বার গোটা শহরকেই তামাকের থাবা থেকে বার করতে উদ্যোগী পুরসভা ও মেয়র। পুরসভার দাবি, কলকাতায় প্রকাশ্যে সিগারেট খাওয়া এ বার দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। তামাক সেবনকারীকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে এবং জরিমানা ধার্য করতে পারে।
পুরসভার তরফে জানা গিয়েছে, এই কাজে যৌথ ভাবে সহযোগিতা করবে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এবং ইন্ডিয়ান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশন। শুক্রবার মেয়র বলেন, ‘‘কলকাতার মানুষকে সুস্থ রাখতেই এই উদ্যোগ। তবে সব কিছু শুধু পুলিশ আর আইন দিয়ে হয় না। মানুষকেও সচেতন হতে হবে। সচেতনতা প্রসারের কাজ আমরা সবাই মিলে করব। পুরসভা চিকিৎসকদের সঙ্গে নিয়ে তামাকমুক্ত শহর গড়ে তুলবে। প্রশাসনও সাহায্য করবে।’’
মাস কয়েক আগে দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, বাঁকুড়া, দক্ষিণ দিনাজপুর— এই চার জেলাকে ‘স্মোক ফ্রি’ হিসেবে ঘোষণা করেছে রাজ্য। দার্জিলিংয়ে প্রকাশ্যে তামাক সেবনের পাশাপাশি প্রকাশ্যে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহারও আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
২০০৭ সালের ভারতের তামাক আইনে অপ্রাপ্তবয়স্কদের তামাকজাত দ্রব্য কেনা বা প্রকাশ্যে সিগারেট এবং গুটখা বিক্রি অপরাধ। স্কুল-কলেজ চত্বরে তামাক বিক্রি করা যাবে না। বাস্তব ছবি বলছে, গোটা দেশের মতো এ শহরেও রবীন্দ্র সদন থেকে ধর্মতলা, শ্যামবাজার থেকে গড়িয়াহাট— সর্বত্রই সেই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখানো চলছে। আইনের কার্যকারিতা না থাকায় তামাক সেবনের জেরে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বহু মানুষ।
স্বাস্থ্য মন্ত্রকের পরিসংখ্যান বলছে, এ রাজ্যে ফি-দিন ৪৩৮ জন শিশু নতুন ভাবে তামাকজাত দ্রব্যের নেশার শিকার হয়। মোট ক্যানসার আক্রান্তের এক তৃতীয়াংশ মুখ ও গলার ক্যানসারে আক্রান্ত। রাজ্যে ৫০% তরুণ-তরুণী তামাক সম্পর্কিত রোগে ভুগছেন। তামাকজাত দ্রব্য সেবনের কারণে প্রতি বছর ১.৪ লক্ষ মানুষ একাধিক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। যাদের একটা বড় অংশ ক্যানসার এবং হৃদ্পিণ্ডের সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ২১.৩% ধোঁয়াযুক্ত (সিগারেট, বিড়ি) এবং ২১.৯% ধোঁয়াবিহীন (গুটখা, পানমশলা) তামাকজাত দ্রব্য সেবন করেন।
মন্ত্রকের এই পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করে আইসিএমআর-এর আশঙ্কা, খুব দ্রুত ভারত বিশ্বের ‘টোবাকো ক্যাপিটাল’ হয়ে উঠবে। তাঁদের আশঙ্কা ২০২০ সালের মধ্যে আরও ১৭ লক্ষের বেশি মানুষ নতুন ভাবে ক্যানসারে আক্রান্ত হবেন। যার বড় কারণ হবে তামাকজাত দ্রব্য সেবন। তবে চিকিৎসকদের একাংশের আশা, প্রশাসন স্মোক ফ্রি শহর গড়ে তুলতে আগ্রহী হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
রাজ্য সরকার এবং কলকাতা পুরসভার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছে চিকিৎসক মহল। তবে তাঁদের আশঙ্কা, এই ঘোষণা যেন স্রেফ কথার কথা হয়েই না থাকে। এ কাজে সচেতনতা প্রসার যেমন প্রয়োজন, তেমনই পুলিশি তৎপরতাও জরুরি বলে মনে করছেন তাঁরা। ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছি। সব সহযোগিতা করতে আমরা তৈরি। ক্যানসারের থাবা থেকে এ শহরকে মুক্ত করতে হলে এটা খুবই প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত।’’ আইএমএ-র রাজ্য সম্পাদক, চিকিৎসক শান্তনু সেন বলেন, ‘‘তামাকের থাবা থেকে মানুষকে বার করতে সরকার উদ্যোগী হচ্ছে। কলকাতার পাশাপাশি গোটা রাজ্যেকে তামাকমুক্ত করতে উদ্যোগী হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। আমরা সরকারের এই ভাবনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। আইএমএ এতে সব রকম সহযোগিতা করবে। মানুষকে সচেতন করতে পারলে তামাকমুক্ত রাজ্য গড়ে তোলার কাজটা সহজ হবে।’’ ক্যানসার চিকিৎসক সৌরভ দত্তের আশা, ‘‘কলকাতা স্মোক ফ্রি শহর হলে মারাত্মক রোগের ঝুঁকি কমবে। আশা রাখব, এই ঘোষণা শুধু কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবিক রূপেও দেখা যাবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy