কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম (বাঁ দিকে), শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সমর্থনে পোস্টার ও বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। —ফাইল চিত্র
এক ব্যানারেই সরগরম গোটা কলকাতা। যাঁকে নিয়ে ব্যানার, তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে এক বছরেরও বেশি। মাঝে একবার দিল্লি গিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে এলেও রাজনীতির মাঠে-ময়দানে একেবারেই নেই। কিন্তু ‘শোভনদা এগিয়ে আসুন’ লেখা ব্যানারে দক্ষিণ কলকাতা ছেয়ে যেতেই জোরদার বাগ্যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে তৃণমূল-বিজেপিতে। কলকাতার ‘বেহাল দশা’ বা ‘অসম্পূর্ণ’ কাজের তত্ত্ব নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। আর সে কথা শুনে মুচকি হেসে রাজ্য বিজেপির সভাপতি বলেছেন, ‘‘মেয়রের টেনশন হচ্ছে।’’
পুরভোটের আগে যে ভাবে রাতারাতি প্রাক্তন মেয়রের ছবি এবং বিজেপির প্রতীক সম্বলিত ব্যানার গোটা দক্ষিণ কলকাতায় ছেয়ে গিয়েছে, তাতে কলকাতার রাজনীতি আচমকা জমজমাট। বিজেপিতে গেলেও বেহালা পূর্বের বিধায়ক তথা শহরের প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় পুরভোটের লড়াই থেকে দূরেই থারবেন— এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল রাজনৈতিক শিবিরে। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে শ’দেড়েক ব্যানার গোটা দক্ষিণ কলকাতায় ছড়িয়ে পড়তেই জোরদার জল্পনা শুরু হয়েছে শোভনকে ঘিরে।
টানা ১০ বছর কলকাতা পুরসভা তৃণমূলের দখলে। এই সময়ের মধ্যেই কলকাতার পুর পরিষেবার আধুনিকীকরণ ঘটানোর নানা কাজ হয়েছে। জঞ্জাল অপসারণ থেকে নিকাশি সংস্কার, আলো থেকে রাস্তাঘাটের হাল বদলানো, পানীয় জল সরবরাহ থেকে পুর কর আদায়ের ব্যবস্থা— অনেক কিছুই গত ১০ বছরে বদলে গিয়েছে বলে তৃণমূল দাবি করে। কিন্তু এই ১০ বছরের মধ্যে সাড়ে ৮ বছর পুরসভা যাঁর হাতে ছিল, সেই শোভন চট্টোপাধ্যায়ই এখন বিজেপিতে। তৃণমূলের মুশকিল সেখানেই।
বিজেপির প্রতীক সম্বলিত যে ব্যানার দক্ষিণ কলকাতায় রাখা হয়েছে, তাতে কলকাতার উন্নয়নের কৃতিত্ব শোভনকেই দেওয়া হয়েছে। মেয়র পদ থেকে শোভন সরে যাওয়ার পরে বেশ কিছু কাজ ‘অসম্পূর্ণ’ থেকে গিয়েছে বা কলকাতার দশা ‘বেহাল’ হয়ে পড়েছে— এমন ইঙ্গিতও ওই ব্যানারগুলিতে দেওয়া হয়েছে। ‘বেহাল’ দশা থেকে কলকাতাকে ‘স্বমহিমায়’ ফেরাতে শোভনকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে।
আরও পড়ুন: ‘শোভনদা’ নামছেন পুরভোটে? পদ্মের ব্যানারে রাতারাতি ছয়লাপ গোটা দক্ষিণ কলকাতা
কলকাতার বর্তমান মেয়র ফিরহাদ হাকিম কিন্তু এই ব্যানার সম্পর্কে নিজের প্রতিক্রিয়া গোপন করেননি। তাঁর জমানায় কলকাতা ‘বেহাল’ বা কলকাতা পুরসভার নানা কাজ ‘অসম্পূর্ণ’— এই তত্ত্বকেই এ দিন সর্বাগ্রে নস্যাৎ করতে চেয়েছেন ফিরহাদ। তিনি বলেন, ‘‘আমার আমলে যে সংস্কারগুলো হয়েছে, সেগুলো তো আমার বিরোধীরা বলবেন না। যে স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ হচ্ছে, কাউকে ধরাধরি করতে হচ্ছে না, সে সব তো আমার বিরোধীরা বলবেন না।’’ কলকাতা পুরসভা দেশের সেরা পুরসভা বলে ফিরহাদ এ দিন দাবি করেছেন। শোভনের নাম তিনি করেননি। কিন্তু তাঁর ব্যানার প্রসঙ্গে নিজের প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে ফিরহাদ শোভনকে গুরুত্বহীন হিসেবে দেখানোর চেষ্টাই করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘কলকাতার মানুষ অসহায় নন, কলকাতার মানুষ কারওর মুখাপেক্ষী নন।’’ তবে কলকাতার উন্নয়ন মাপার প্রশ্নে শোভনের সঙ্গে নিজের কার্যকালের তুলনাও ফিরহাদ হতে দিতে চাননি। তিনি সরাসরি দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীকে সামনে নিয়ে এসেছেন এ দিন। ফিরহাদ বলেছেন, ‘‘কলকাতার উন্নয়ন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিকল্পনায় হচ্ছে। সুতরাং কলকাতা পুরসভা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বেই এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে।’’
মেয়র ফিরহাদ হাকিমের এই প্রতিক্রিয়া দেখে বিজেপি উল্লসিত। শোভন চট্টোপাধ্যায়কে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ব্যানার কারা লাগালেন, তা তাঁর জানা নেই বলে রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ এ দিন মন্তব্য করেছেন। কিন্তু তার সঙ্গেই ফিরহাদের উদ্দেশে এ দিন তীব্র কটাক্ষ ছুড়েছেন দিলীপ। ফিরহাদের এই প্রতিক্রিয়াকে ‘স্বাভাবিক’ আখ্যা দিয়ে দিলীপ বলেছেন, ‘‘ওঁর টেনশন আছে। ওঁকে যাঁরা চাকরি দিয়েছেন, তাঁদের খুশি করা ওঁর কাজ। শোভনদার কাজ বা শোভনদার নেতৃত্ব সম্পর্কে সবাই জানেন। তাই শোভনদা যদি নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন, তা হলে ফিরহাদ হাকিমের পক্ষে সামনের বার মেয়র হওয়াটা কঠিন হবে। সেই টেনশন থেকেই তিনি এই সব কথা বলছেন।’’
আরও পডু়ন: ‘মোদী আশ্বস্ত করেছেন, সারা দেশে এনআরসি হবে না’, বললেন উদ্ধব
তা হলে কি ফিরহাদ তথা তৃণমূলের অস্বস্তি বাড়াতে বিজেপি-ই এই ব্যানার লাগানোর ব্যবস্থা করল? দিলীপ ঘোষ জানিয়েছেন, বিজেপির তরফ থেকে এই রকম কোনও ব্যানার লাগানোর নির্দেশ ছিল না। তবে দলের কর্মীরা নিজেদের উদ্যোগে এমনটা করে থাকতে পারেন, সেই সম্ভাবনা রাজ্য বিজেপির সভাপতি উড়িয়ে দেননি। দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘‘হতে পারে ওখানে (দক্ষিণ কলকাতায়) আমাদের কর্মীরা করেছেন বা সাধারণ নাগরিকরা করেছেন। তাঁরা চান, শোভনদার নেতৃত্বে কলকাতা পুরসভা এগিয়ে চলুক। সে রকম আহ্বান করা হয়েছে। শোভনদা সক্রিয় হন, এটা সবাই চায়।’’
রাজ্য বিজেপির সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদারও ফিরহাদ হাকিমকে এ দিন কটাক্ষ করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘পুরসভা তো শোভনবাবু সাড়ে আট বছর চালিয়েছেন। তাঁর অভিজ্ঞতা তো রয়েছে। আর তাঁর অভিজ্ঞতা যে ফিরহাদ হাকিমের চেয়ে অনেক বেশি, তা সাধারণ মানুষও বুঝতে পারছেন।’’ দল শোভনের অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে বলেও জয়প্রকাশ এ দিন মন্তব্য করেছেন।
কলকাতার প্রাক্তন মেয়রের ঘনিষ্ঠ বৃত্ত থেকেও এ দিন কটাক্ষের তির ধেয়ে গিয়েছে বর্তমান মেয়রের দিকে। কলকাতাকে সেরা পুরসভা হিসেবে দাবি করে যে মন্তব্য এ দিন ফিরহাদ করেছেন, সে প্রসঙ্গ টেনে তাঁকে খোঁচা দিয়েছেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘ফিরহাদ হাকিম ঠিকই বলেছেন— কলকাতাই সেরা পুরসভা। কিন্তু সেরাটা তাঁর আমলে হয়নি। শোভন চট্টোপাধ্যায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম কলকাতাকে সেরা বানিয়েছিল।’’ এর পরেই আরও ঝাঁঝালো মন্তব্য করেন বৈশাখী। তিনি বলেন, ‘‘এখন তো চারিদিকে দেখছি ‘টক টু মেয়র’ হোর্ডিং। মেয়র নাকি সবার সঙ্গে কথা বলছেন। শোভন চট্টোপাধ্যায় এত কথা বলতেন না, কাজ করতেন। তাই কলকাতাকে সাজিয়ে দিয়ে যেতে পেরেছিলেন। সেই সাজানো পুরসভা হাতে পেয়েছিলেন বলেই এত কথা বলার সুযোগ হচ্ছে। না হলে আর কথা বলতে হত না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy