পোড়া কাগজের মধ্যে মাধ্যমিকের মার্কশিটের খোঁজে দেবজিৎ বিশ্বাস। রবিবার। নিজস্ব চিত্র
তখন সকাল ১০টা। আগুনের তাপে দুমড়ে যাওয়া টিন আর ঘরের যাবতীয় জিনিসের ধ্বংসস্তূপ হাতড়ে চলেছে সে। যদি সম্বলটুকু পাওয়া যায়, সেই আশায়। অনেক খুঁজে মিলল বটে পোড়া কাগজের একটা গোছা। কিন্তু নাহ্! সেখানেও তো নেই মাধ্যমিকের মার্কশিট, অ্যাডমিট কার্ড! তবে কী হবে? পড়াশোনার কি এখানেই ইতি? চোখের সামনে যেন স্বপ্নগুলোকে দূরে সরে যেতে দেখছিল বছর ষোলোর দেবজিৎ বিশ্বাস।
অথচ দিন কয়েক আগেই ৭৬ শতাংশ নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করায় তার সঙ্গেই খুশি হয়েছিল গোটা পরিবার। শনিবার গভীর রাতে কেষ্টপুরের আগুন যেন কেড়ে নিয়েছে সেই আনন্দ। কেষ্টপুরে ভিআইপি রোড সংলগ্ন শতরূপা পল্লির পাশে ভস্মীভূত দোকানগুলোর একটায় পরিবার নিয়ে থাকত দেবজিৎ। দোকান বলতে বেড়া আর টিনের চালের অস্থায়ী আসবাবপত্রের দোকান। সেই দোকানের উপরেই মাচা করে মা, বাবা, দিদি আর বোনের সঙ্গে থাকত ওই কিশোর।
শনিবার রাত প্রায় আড়াইটে নাগাদ যখন আগুন লাগে, আশপাশের প্রবল চিৎকারে ঘুম ভেঙেছিল দেবজিতের। সে বলে, “উঠে দেখি, আশপাশ দাউদাউ করে জ্বলছে। দোতলা থেকে আমি আর বাবা দৌড়ে নেমে আসি। মা-ও নেমে আসেন। কিন্তু দিদি আর বোন তখনও নামতে পারেনি।”
ফের কোনও রকমে উপরে উঠে দিদি আর বোনকে নিয়ে বেরিয়ে আসে সে। তত ক্ষণে বাড়ির সব কিছু দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করে দিয়েছে। আগুনের শিখা যখন সব কিছু খাক করে দিচ্ছে, তখন দেবজিতের মনে পড়ে মাধ্যমিকের মার্কশিট, অ্যাডমিট কার্ড আর সার্টিফিকেটের কথা। একাদশ শ্রেণির জন্য সদ্য কেনা বইও রয়ে গিয়েছে ঘরে। কিন্তু ঘরে ঢুকে সেগুলি উদ্ধার করার অবস্থা ছিল না।
রবিবার ছাই হাতড়াতে হাতড়াতে ক্লান্ত কিশোর বলে, “এই তো দিন কয়েক আগেই স্কুল থেকে নিয়ে এলাম মাধ্যমিকের মার্কশিট, সার্টিফিকেট। আগুন লাগার পরে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এসেছি। তখন নিজেদের বাঁচাতে গিয়ে ওগুলো রক্ষা করতে পারলাম না। সেই আফশোস যাচ্ছে না।” বাড়ির পাশে কেষ্টপুরের প্রফুল্লকানন দেশপ্রিয় বিদ্যালয় থেকে এ বার মাধ্যমিক পাশ করেছে সে। গত দেড় বছর স্কুলে যাওয়া হয়নি, পরীক্ষা হয়নি। বাড়িতে যতটা পেরেছে, সে পড়াশোনা করেছে। বাণিজ্য নিয়ে পড়তে চাওয়া দেবজিৎ তিল তিল করে জমানো টাকার কিছুটা দিয়ে বই কিনেছিল। বাকি টাকার সঙ্গে সে সব বই গিয়েছে পুড়ে। দিদি আর বোনেরও যাবতীয় বই-খাতা পুড়ে গিয়েছে। দেবজিতের মা অর্চনা বিশ্বাস বলেন, “আমরা যে পোশাকটা পরে বেরিয়ে এসেছি, এখন সেটাই আমাদের সম্বল। ছেলে খালি পায়ে বেরিয়ে এসেছিল। এক প্রতিবেশী ওকে চটিটা পরতে দিয়েছেন।
দেবজিৎকে আশ্বস্ত করে এক প্রতিবেশী জানান, সদ্য পাওয়া মার্কশিট, সার্টিফিকেট, অ্যাডমিট কার্ডের ডুপ্লিকেট কপি সে নিশ্চয়ই মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অফিসে গেলে পেয়ে যাবে। তবু কিশোর আশ্বস্ত হতে পারছে না।
পোড়া ঘরের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলে দেবজিৎ, “সবই অনিশ্চিত হয়ে গেল। বাড়িটাই নেই। মাধ্যমিক পাশ করে ভাবছিলাম, কী ভাবে এগোব। বাবার পাশেও তো দাঁড়াতে হবে। কিন্তু পড়াশোনাটা কি আর চালাতে পারব?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy