Advertisement
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
স্বঘোষিত দাদাদের দৌরাত্ম্যে ত্রস্ত শহরবাসী, প্রতিকার কি মিলবে?
Auto

ভাড়া থেকে রুট, অটোর রাশ ‘দাদাদের’ হাতেই

‘দাদা-তন্ত্র’ নিয়ে আরও বড় অভিযোগ রয়েছে রুট পারমিট পাওয়ার ক্ষেত্রে।

অবাধে: সামনের সিটে পা তুলে বসেই অটো চালাচ্ছেন চালক। রবিবার, রাজাবাজারে। নিজস্ব চিত্র

অবাধে: সামনের সিটে পা তুলে বসেই অটো চালাচ্ছেন চালক। রবিবার, রাজাবাজারে। নিজস্ব চিত্র

নীলোৎপল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২০ ০৩:১৩
Share: Save:

জটিল পাটিগণিত চলছে। এক দিনে সর্বোচ্চ কতগুলি অটো রুটে নামালে সর্বাধিক আয় করা যাবে— সেই হিসেব বার করতে হবে। যাত্রী-পিছু ভাড়া কত হলে সব চেয়ে বেশি ‘লাভের গুড়’ দাদার ট্যাঁকে ঢুকবে, বার করতে হবে তা-ও! অটোর চালক বা মালিক নন, অভিযোগ, এই হিসেব কষছেন পাড়ার তথা রুটের ‘দাদারা’ই!

কাটমানি ঘিরে ব্যাপক শোরগোলের পরে জেলায় জেলায় এ বার বিতর্কের কেন্দ্রে আমপানে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকারি ক্ষতিপূরণ। সেই ক্ষতিপূরণের টাকা পাইয়ে দিতে স্বজনপোষণ এবং দুর্নীতির একের পর এক অভিযোগ উঠছে প্রতিদিন। লকডাউনের কড়াকড়ি উঠতেই কলকাতায় ফের সক্রিয় হয়ে ওঠা ‘দাদার দাপট’ যে বিষয়গুলি ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে, তার মধ্যে অটোর রুট অন্যতম, জানাচ্ছেন ভুক্তভোগীরাই। বি কে পাল থেকে কাশীপুর রুটের তেমনই এক অটোচালক বললেন, “আট টাকা ভাড়া। এখন ১৫ টাকা করে নিতে বলেছেন দাদা। তিন জনের বেশি লোক নিতেও বারণ করেছেন। চার জন নিয়ে গেলে আগে হত ৩২ টাকা। এখন তিন জনে হয় ৪৫ টাকা। বাড়তি যে ১৩ টাকা আয় হচ্ছে, তার দশ টাকাই ওই দাদার পকেটে চলে যাচ্ছে। কিছু বলারও উপায় নেই, কারণ আমাকে তো রুটে ঢুকিয়েছিলেন ওই দাদাই!”

শহরে অটোর দাপটের পিছনে তোলাবাজির বিরাট চক্র এ ভাবেই কাজ করে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। টাকা দিয়ে ‘সেট’ করে রাখা শাসক দলের নেতা-দাদাদের জোরেই অটোচালকদের একাংশ যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো বা নামানোর সাহস পান বলেই অভিযোগ। পুলিশি নির্দেশ উড়িয়ে অটোয় তারস্বরে তাঁরা বক্স বাজান। নিজের পাশে একাধিক যাত্রী বসিয়ে বেপরোয়া ভাবে চলাচল করেন। অভিযোগ, ওই দাদাদের জোরেই ফ্লাইং অটো নজর ‘এড়িয়ে যায়’ প্রশাসনের।

‘দাদা-তন্ত্র’ নিয়ে আরও বড় অভিযোগ রয়েছে রুট পারমিট পাওয়ার ক্ষেত্রে। এই মুহূর্তে শহর ও শহরতলি মিলিয়ে প্রায় ৪৭৫টি নথিভুক্ত অটো রুট রয়েছে। চাইলেই রুটগুলিতে নতুন অটো নামানো যায় না। কারণ, রুট-পিছু কত অটো চলছে বা ক’টা অটো থাকতে পারে, সেই সংখ্যা তালিকাবদ্ধ করা থাকে। পুরনো অটো চলার অযোগ্য হয়ে গিয়েছে, সেই প্রমাণ দেওয়ার পাশাপাশি সেই অটো নষ্ট করার প্রক্রিয়ার ভিডিয়োগ্রাফি করে প্রশাসনের কাছে পাঠাতে হয়। তবেই নতুন অটোর ছাড়পত্র মেলে। কিন্তু অটোচালকদের বড় অংশেরই অভিযোগ, এ সবই খাতায়-কলমে সীমাবদ্ধ। স্রেফ ‘দাদার আশীর্বাদ’ থাকলেই আর কিছুর প্রয়োজন হয় না। এই মুহূর্তে নতুন পারমিট দেওয়া বন্ধ থাকলেও স্রেফ দাদাকে তুষ্ট করতে পারলেই রুটে নেমে পড়া যাচ্ছে অটো নিয়ে। বহু গলিপথে আবার পারমিট ছাড়াই চালু হয়ে গিয়েছে নতুন রুট।

রানিকুঠি-বাঘা যতীন স্টেশন রুটের এক অটোচালকের বক্তব্য, ‘‘নতুন অটোর দাম খুব বেশি হলে সাড়ে চার লক্ষ টাকা। তার পরেও কেন ৯-১০ লক্ষ টাকা দিতে হয়, সেটাই বড় প্রশ্ন।’’ রুট পারমিটের কাজ করানো এক দালাল বললেন, “গেট পাস বোঝেন? যে রুটে যত বেশি ট্র্যাফিক গার্ড, সেই রুটে গার্ড-পিছু তত বেশি টাকা দিতে হয়। ওই টাকাই আমাদের কথায় গেট পাস। তার থেকে প্রথমেই টাকা বেশি দিয়ে গেট পাসের ঝামেলা এড়ানোই ভাল নয় কি! বাকিটা দাদারা দেখে দেবেন।”

অভিযোগ, এই ‘দেখে দেওয়া’র নামেই প্রতি রুটে চলছে দাদাদের জুলুম। এই মুহূর্তে টালিগঞ্জ থেকে চলা একাধিক রুট, বেহালার কয়েকটি এবং গড়িয়াহাট-কসবা রুটে দাদাদের ঠিক করে দেওয়া ভাড়া সব চেয়ে বেশি। একই অবস্থা গিরিশ পার্ক থেকে ফুলবাগান, উল্টোডাঙা থেকে বি কে পাল রুটের। সল্টলেকের একাধিক রুট এবং বেলেঘাটা ও শিয়ালদহ রুটেরও ভাড়া দাদারা দ্বিগুণ করে দিয়েছেন লকডাউনের লোকসান পূরণ করতে। এমনটাই জানাচ্ছেন অটোচালকেরা।

লালবাজারের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিষয়টি পরিবহণ দফতরের দেখার কথা। অভিযোগ পেলে পুলিশ ব্যবস্থা নেয়। রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। বিষয়টি জানিয়ে তাঁকে মেসেজ করা হলেও উত্তর দেননি। অটো ইউনিয়নগুলির দায়িত্বপ্রাপ্ত তৃণমূল নেতা অশোক চক্রবর্তী (মানা) বলেন, ‘‘তিন মাস অটোচালকেরা না-খেয়ে ছিলেন। তার ফলে কোনও চালক যদি একটু বেশি টাকা চান, তাতে সমস্যা কী? কারও পক্ষেই সব কিছু শুদ্ধ করা সম্ভব নয়।’’

অতএব, দাদাদের এবং তাঁদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা বেপরোয়া অটোর দাপট চলছেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Auto Kolkata Police TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy