Leela Majumdar was the magic lantern for the young readers of Bengali literature dgtl
photos
‘বিলেত থেকে এয়েচ?’ ভাল বাংলা না জানায় লীলা মজুমদারকে শুনতে হয়েছিল কটূক্তিও
অর্পিতা রায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৩:৪৭
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২৮
১। বড় হওয়া পাশ্চাত্য প্রভাবে। একটা সময় পর্যন্ত ভাল বাংলা জানতেন না। কিন্তু জীবনের পাকদণ্ডিতে হলদে পাখির পালকের কলম লিখে রেখেছিল অন্য রকম কিছু। তাঁর রেখে যাওয়া বর্মিবাক্সের ঐশ্বর্য অফুরান। বাঙালির কয়েক প্রজন্ম ধরে শৈশব লীলাময় হয়েছে তাঁর জন্য।
০২২৮
২। গড়পারের বিখ্যাত রায়চৌধুরী পরিবারে উপেন্দ্রকিশোরের ছোট ভাই প্রমদারঞ্জন ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের জমি জরিপ বিভাগের কর্মী। কাজের সূত্রে সারা দেশে ঘুরতে হত তাঁকে। তবে তাঁর মেয়ের জন্ম কলকাতাতেই। ১৯০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। সদ্যোজাতর নাম রাখা হয়েছিল ‘লীলা’।
০৩২৮
৩। শৈশবের প্রথম দশক কেটেছিল শিলং শহরে। কাজের সূত্রে সেই শহরেই তখন ছিলেন প্রমদারঞ্জন। রাশভারী বাবাকে কিছুটা ভয়ই পেতেন লীলা। তাঁর জগৎ আবর্তিত হত মাকে ঘিরে। তাঁর মা সুরমা দেবী ছিলেন অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী। লীলার জীবনে ও লেখায় মায়ের গভীর প্রভাব পড়েছিল।
০৪২৮
৪। শিলঙের লোরেটো কনভেন্টের নাম ছিল মিডল ইংলিশ স্কুল। সেখানেই পড়াশোনা শুরু লীলার। স্কুলে বাংলা পড়ানো হত না। বাংলার অক্ষরজ্ঞান হয়েছিল মায়ের কাছে, বাড়িতে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আখ্যানমঞ্জরীর প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ থেকে মেয়েকে বাংলা পড়াতেন সুরমাদেবী।
০৫২৮
৫। লীলার ১২ বছর বয়সে প্রমাদরঞ্জন বদলি হয়ে কলকাতায় এলেন। তার আগেও কলকাতায় এসেছেন লীলা। কিন্তু পাকাপাকি ভাবে থাকতে আসা সেই প্রথম। তবে শিলং তাঁর মনের মধ্যে চুপটি করে বসেছিল আজীবন। স্মৃতিকথা ‘আর কোনোখানে’ তো বটেই। শিলং ঘুরেফিরে এসেছে তাঁর বহু গল্প ও উপন্যাসে।
০৬২৮
৬। শিলঙের বাড়িতে পরিচারক ছিলেন ইলবন। তাঁর গল্পের ভাণ্ডার ছিল অফুরন্ত। বালিকাজীবনে গল্পের সেই উৎসই পরে নতুন জন্ম পেয়েছে সাহিত্যিক লীলার কলমে। তখন তাঁর নাম হয়ে গিয়েছে ‘দুমকার ঝগড়ু’। তাঁর সাবলীল এবং ঝরঝরে ভাষায় মিলে মিশে গিয়েছিল সুকুমার রায় এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তুলি-কলম।
০৭২৮
৭। তাঁর কল্পনার তুলি কলম রঙিন হতে কিন্তু বাধা পেয়েছিল কলকাতায় পা রাখার পরে। কারণ, ভাষার অন্তরায়। যে লীলা কৈশোরে পৌঁছবার আগেই নীল খাতা ভরিয়ে ফেলেছেন ইংরেজি গল্পে, তাঁর কাছে গোল্লাছুট হয়ে যায় বাংলা ব্যাকরণের সমাস এবং কারক বিভক্তি। কলকাতায় এসে তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল সেন্ট জনস ডায়োসেশন স্কুলে।
০৮২৮
৮। বাংলা না জানার কারণে প্রতি পদে তাঁকে হোঁচট খেতে হত। সহপাঠীদের উপহাসের পাত্রী হতে হতে লীলা একদিন ঠিক করলেন, বাংলা তাঁকে শিখতেই হবে। কানে সবসময় বাজত চশমার উপর দিয়ে পিট পিট করে তাকানো পণ্ডিতমশাইয়ের প্রশ্ন, ‘বিলেত থেকে এয়েচ?’
০৯২৮
৯। কঠিন অধ্যবসায়ে আপাত অসাধ্যকে লীলা পরিণত করেছিলেন ‘অনায়াস স্বাচ্ছন্দে’। তাঁর পরিশ্রম বৃথা গেল না। ইংরেজির মতো বাংলাকেও তিনি করে নিলেন তূণীরের বাণ। কয়েক দশক পেরিয়ে তাঁর কলমশরে বিদ্ধ হলেন অসংখ্য পাঠক।
১০২৮
১০। অনাগত সেই ভবিষ্যতের ছবি স্পষ্ট হয়েছিল স্কুলের শেষবেলাতেই। ১৯২৪ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন জলপানি আর সোনার মেডেল নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্তি হল পুরস্কারের বহুমূল্যের বই। সে দিন মাথায় স্নেহার্শীবাদের হাত রেখেছিলেন পণ্ডিতমশাই।
১১২৮
১১। মাত্র ২ নম্বরের জন্য বাংলায় লেটার মার্কস পাননি। পণ্ডিতমশাইয়ের আক্ষেপের উত্তরে লীলা বলেছিলেন, “আপনি দুঃখ করবেন না। গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করা যায়, কিন্তু পক্ষীরাজ করা যায় না।” অবশ্য ছাত্রী যে দিন পক্ষীরাজ হয়ে আকাশে ডানা মেলেছিলেন, সে দিন পণ্ডিতমশাইও চলে গিয়েছেন বহু দূরে। আকাশ থেকেই হয়তো দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করেছিলেন ছাত্রীর উড়ানকে।
১২২৮
১২। পড়াশোনার পাশাপাশি চলছিল ইংরেজি ও বাংলায় সাহিত্যচর্চা। ইচ্ছে হল, বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরে গল্প পাঠাতে। গোপনে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় গল্প পাঠিয়েছিলেন কিশোরী লীলা। কিন্তু ছাপা হয়নি। পরে বড়দা সুকুমার রায় তাঁর কাছে গল্প চাইলেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকার জন্য। পরবর্তীতে ‘সন্দেশ’-এর পাতায় অগণিত মণিমুক্তোর জন্ম দিয়েছিল তার মায়াবি কলম।
১৩২৮
১৩। দাদার কথায় গল্প লিখলেন ‘লক্ষ্মীছাড়া’। সেই গল্পই নাম প্রকাশিত হল ১৯২৩ সালে সন্দেশ পত্রিকার ভাদ্র সংখ্যায়। তবে গল্পের নাম সুকুমার রায় প্রকাশিত হওয়ার আগে পাল্টে করে দিয়েছিলেন ‘লক্ষ্মী ছেলে’। পরের গল্প সন্দেশে বার হওয়ার আগে চলে গেলেন সুকুমার রায়ই। ১৯২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। এর পর দীর্ঘ ৮ বছর স্কুলকলেজের পত্রপত্রিকা ছাড়া তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়নি। প্রথম গল্প মনের মতো হয়নি লীলার। বাইরের পত্রিকায় তাঁর দ্বিতীয় প্রকাশিত গল্পের নাম ছিল ‘দিন দুপুরে’।
১৪২৮
১৪। ১৯২৬ সালে আই এ পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান। ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে ১৯২৮ সালে স্নাতক এবং তার ২ বছর পরে স্নাতকোত্তর। এম এ পাশ করার পরেই চাকরি পান লীলা। দার্জিলিঙের মহারানি স্কুলে ১৯৩১ সালের মার্চ থেকে মে, এই ৩ বছর চাকরি করেছিলেন। সেখানেই প্রথম চাক্ষুষ দেখলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।
১৫২৮
১৫। প্রথম আলাপের বহু আগে থেকেই পারিবারিক পরিচয় ছিল। সেই সূত্রেই লীলাকে আমন্ত্রণ জানালেন বিশ্বকবি। শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতার জন্য। মন থেকে সাড়া সেভাবে না দিলেও এই ডাক উপেক্ষা করতে পারেননি। ইংরেজি অনার্স ক্লাসের পাশাপাশি শান্তিনিকেতনে তিনি নিতেন শিশুবিভাগে গল্প বলার ক্লাসও।
১৬২৮
১৬। সে সময় তাঁর বেতন ছিল ৮৫ টাকা। সময়ের নিরিখে তার মূল্য কম নয়। কিন্তু ১ বছরের বেশি বোলপুরে থাকলেন না তিনি। গুরুদেবের প্রতিষ্ঠান ঘিরে তুচ্ছ দলাদলি তাঁকে পীড়া দিয়েছিল। তিনি কলকাতায় চলে এলেন। কিছু দিন থাকলেন অধ্যাপিকা দিদির সঙ্গে।
১৭২৮
১৭। ১৯৩২ সালে আশুতোষ কলেজের মহিলা বিভাগ খোলা হল। তার দায়িত্ব তরুণী লীলার হাতে তুলে দিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। পাশাপাশি আংশিক সময়ের জন্য অধ্যাপনা করতেন গোখলে মেমোরিয়াল কলেজেও।
১৮২৮
১৮। কিন্তু বছরখানেক পরে ছেড়ে দেন কলেজের চাকরিও। ১৯৩৩ সালে তিনি বিয়ে করেন বিখ্যাত দন্ত চিকিৎসক সুধীরকুমার মজুমদারকে। নিজের সিদ্ধান্তে বিয়ে করার জন্য বাবার বিরাগভাজন হতে হয়েছিল। কিন্তু পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়েই বিয়ে করেছিলেন তিনি।
১৯২৮
১৯। বিয়ের পরে তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে দেন। দীর্ঘ দিন নিজেকে আবদ্ধ রেখেছিলেন ঘরকন্না ও সাহিত্যচর্চায়। স্বামীর উৎসাহে লীলা আরও বেশি করে মন দেন লেখালেখিতে। বিয়ের বহু পরে ১৯৫৩ সালে যোগ দেন আকাশবাণীতে। দীর্ঘ ১৪ বছর তিনি যুক্ত ছিলেন কলকাতা বেতারকেন্দ্রের সঙ্গে। তার পর নিয়মিত চাকরি আর করেননি।
২০২৮
২০। মহিলা শ্রোতাদের জন্য অনুষ্ঠান বিভাগকে তিনি ঢেলে সাজিয়েছিলেন। তাঁর তৈরি ‘মণিমালা’ অনুষ্ঠান খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। মহিলাদের আটপৌরে সমস্যাকে তুলে ধরেছিলেন সেখানে। তাঁর যত্নআত্তিতে নিটোল হয়ে বেড়ে উঠেছিল ‘মণিমালা’-র সংসার।
২১২৮
২১। লীলা মজুমদার নিজেও ছিলেন গৃহস্থালীর কাজে সুনিপুণ। ঘরোয়া থেকে সাহেবি, পাঁচমিশেলি থেকে নিমন্ত্রণ বাড়ি—যে কোনও রান্নায় তিনি ছিলেন জুড়িহীন। তাঁর লেখা রান্নার বই অনেক মহিলারই নিঝুম দুপুরের সঙ্গী।
২২২৮
২২। শিশু ও কিশোরদের জন্য তাঁর সাহিত্যভাণ্ডার তো অফুরান। ‘হলদে পাখির পালক’, ‘টং লিং’, ‘নাকু গামা’, ‘পদীপিসির বর্মীবাক্স’, ‘বদ্যিনাথের বড়ি’, ‘দিন দুপুরে’, ‘বক ধার্মিক’, ‘গুপীর গুপ্ত খাতা’, ‘বাতাস বাড়ি’, ‘খেরোর খাতা’, ‘পাকদণ্ডি’, ‘বক বধ পালা’, ‘চিনা লণ্ঠন’-সহ অসংখ্য গল্প উপন্যাসে তিনি সাজিয়েছেন বর্ণময় শৈশবকে। একাধিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে তাঁর লেখা শিশু ও কিশোর সাহিত্য।
২৩২৮
২৩। জোনাথন সুইফ্টের লেখা ‘গালিভরস ট্র্যাভেল’ এবং আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ বইদু’টি বাংলায় অনুবাদও করেছিলেন তিনি।
২৪২৮
২৪। স্বামী প্রয়াত হয়েছিলেন আগেই, ১৯৮৪ সালে। দুই সন্তান, নাতি নাতনিদের সঙ্গে কেটে যাচ্ছিল সময়। লেখালেখি বন্ধ করে দিয়েছিলেন শেষ দিকে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মরচে ধরেনি তাঁর হাসিখুশি, রসিকতাপ্রিয় স্বভাবে।
২৫২৮
২৫। গল্প বলার আসর ছেড়ে ৯৯ বছর বয়সে পাততাড়ি গুটিয়ে ফেললেন তিনি। ২০০৭ সালের ৫ এপ্রিল। রয়ে গেল তাঁর সাহিত্যভাণ্ডার। তিনি চলে গেলেও তাঁর কথা ফুরিয়ে যায় না। নটেগাছটিও সতেজ ও সজীব রয়ে যায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।