বিপন্ন: এক সময়ে ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ডের ১০০টি ‘এনডেঞ্জারড সাইটস’-এর অন্যতম ছিল এই ডালহৌসি স্কোয়ার। এখনও সেই বিপন্নতা কাটেনি। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
সময়টা ২০১০ সাল। কলকাতার ঐতিহ্য সংরক্ষণে তাঁরা কতটা তৎপর, চেন্নাইয়ে অনুষ্ঠিত একটি আলোচনায় তা তুলে ধরেছিলেন কলকাতা পুরসভার প্রতিনিধি। কিন্তু চমক ছিল অন্য জায়গায়। ওই প্রতিনিধি ঐতিহ্য সংরক্ষণে পুর তৎপরতার কথা জানিয়েও ‘প্রেজ়েন্টেশন’-এ একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উল্লেখ করেছিলেন। তা হল, ‘ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ড’ (ডব্লিউএমএফ)-এর তালিকা অনুযায়ী, শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ডালহৌসি স্কোয়ার (বি বা দী বাগ) ১০০টি ‘এনডেঞ্জারড সাইটস’-এর মধ্যে অন্যতম। সেই কারণে ডব্লিউএমএফ-এর তরফে ২০০৪ ও ২০০৬ সালে ডালহৌসি স্কোয়ারকে ‘ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ওয়াচ’-এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যাতে ওই এলাকার সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্যের পাশাপাশি সচেতনতাও বাড়ানো যায়।
কিন্তু ১০ বছর পেরোনোর পরেও দেখা যাচ্ছে, এ বিষয়ে যত আলোচনা-কথাই হোক না কেন, কলকাতা রয়েছে সেই কলকাতাতেই! নিজের ঐতিহ্যের ‘বিপন্নতা’ নিয়ে। আর সে কারণেই হয়তো ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত কাজে সংস্থা নির্বাচনের জন্য পুরসভার ডাকা দরপত্র বাতিল হয়ে যায়। কারণ, ঐতিহ্য সংরক্ষণে তেমন সাড়া পাওয়া যায় না।
পুরসভার ‘হেরিটেজ কনজ়ার্ভেশন কমিটি’ (এইচসিসি) সূত্রের খবর, সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হেরিটেজ ভবনগুলির গায়ে নীল ফলক লাগানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ২০১৯ সালের অগস্টে। তথ্য বলছে, শহরে গ্রেড ওয়ান হেরিটেজ ভবনের সংখ্যা ৬১১, গ্রেড ২এ এবং ২বি ভবনের সংখ্যা যথাক্রমে ১৯৭ ও ১০৯। সব মিলিয়ে ৯১৭টি। সব ক’টি ভবনেই নীল ফলক লাগানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই ফলকে ভবনটি কোন ক্যাটেগরির (গ্রেড ওয়ান, গ্রেড ২এ না ২বি), তা লেখার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বাড়ি বা ভবনটি স্থাপত্যশৈলী অথবা ঐতিহাসিক গুরুত্ব বা অন্য কোন কারণে হেরিটেজ, সেটারও উল্লেখ থাকবে বলে ঠিক হয়েছিল।
পুরসভা সূত্রের খবর, দীর্ঘ টালবাহানার পরে কোনও বেসরকারি সংস্থাকে ফলক লাগানোর দায়িত্ব দেওয়ার জন্য সম্প্রতি দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু দেখা যায়, ওই দরপত্রে ‘বিডার’ হিসেবে মাত্র একটি সংস্থাই অংশ নিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, প্রথম বার ডাকা দরপত্রের সময়ে ন্যূনতম তিনটি সংস্থাকে অংশগ্রহণ করতেই হবে। না হলে দরপত্র বাতিল হয়ে যায়। ফলে সেই নিয়ম মেনেই সংশ্লিষ্ট দরপত্রটি বাতিল হয়। রীতি অনুযায়ী, প্রথম বার ডাকা দরপত্র বাতিল হলে দ্বিতীয় বার ফের তা ডাকা যায়। তবে সে ক্ষেত্রে নিয়ম শিথিল করা হয়। তাতেও যদি সাড়া না পাওয়া যায়, তা হলে তৃতীয় বার দরপত্র আহ্বান করা হয়। তৃতীয় বারের ক্ষেত্রে একটি সংস্থা অংশগ্রহণ করলেও কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলে তখন কাজ শুরু করা যায়। এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘এখন যা অবস্থা, তাতে চলতি আর্থিক বছরে দ্বিতীয় বার দরপত্র আর ডাকা হবে না। পরবর্তী অর্থবর্ষে তা ডাকা হতে পারে।’’
তবে ঐতিহ্য রক্ষায় প্রত্যাশিত সাড়া না পাওয়া গেলে কী হবে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ জানাচ্ছেন, শহরের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি নিয়ে কখনও এতটা আলোচনা হয়নি, যা সাম্প্রতিক সময়ে হচ্ছে। কারণ, পুরো বিষয়টির সঙ্গে রাজনৈতিক আঙ্গিক জড়িয়ে গিয়েছে। রাজ্য বা কেন্দ্রের শাসক দল কলকাতার ঐতিহ্য, সংস্কৃতির প্রসঙ্গ বার বার তুলে ধরছে তাদের রাজনৈতিক ভাষ্যে। সে কারণেই গত বছরে কলকাতা সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও মন্তব্য করেছিলেন, বাংলার ঐতিহ্য-গৌরব তিনি দেশে-বিদেশে সবার সামনে তুলে ধরবেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর মতে, ‘‘২০২১ সালের নির্বাচন অনেকাংশেই আইডেন্টিটি বা পরিচয়সত্তার উপরে নির্ভরশীল হতে যাচ্ছে। যখন যেখানে যে পরিচয়টি প্রয়োজন, সেটির কথা বলছে সব পক্ষই। সময় বিশেষে কখনও তা বাঙালি, কখনও হিন্দু-মুসলিম, কখনও মতুয়া-সহ একাধিক আইডেন্টিটি-কেন্দ্রিক।’’
আর সেই পরিচয়সত্তারই অন্যতম হল শহরের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি— এমনটাই মনে করছেন হেরিটেজ সংরক্ষণবিদদের একাংশ। এক সংরক্ষণবিদ জানাচ্ছেন, বোঝাই যাচ্ছে, এ বারের নির্বাচনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে ঐতিহ্য- সংস্কৃতির বিষয়টি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তা-ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের কাজে কোনও সংস্থার তরফে সাড়া পাওয়া যায় না। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঐতিহ্য, সংস্কৃতির যতটা গুরুত্ব রয়েছে, বাস্তব ক্ষেত্রেও ততটা রয়েছে কি না, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy