আজ থেকে ১৪০ বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আনন্দমঠ-এ বসন্ত রোগের মহামারির বর্ণনায় লিখেছিলেন, ‘কেহ কাহাকে দেখে না; মরিলে কেহ ফেলে না। অতি রমণীয় বপু অট্টালিকার মধ্যে আপনাআপনি পচে।... গৃহবাসীরা রোগী ফেলিয়া পলায়।’ করোনাকালীন কলকাতার ছবি ভেসে ওঠে কি? নগরায়ণে গতির সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক মহামারিতে বিপন্ন হয়েছে এ শহরের জনজীবন। ১৮৯৮-এ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা প্লেগ সম্পর্কে প্রেমাঙ্কুর আতর্থী মহাস্থবির জাতক-এ লিখেছিলেন, কলকাতা কর্পোরেশন টিকা দিতে চাইলে লোকে সহজে নিতে চায়নি। সংশয়বিদ্ধ শহরবাসীর দোলাচল বেড়েছিল গুজবে: টিকা নিলে মৃত্যু নিশ্চিত। পাশ্চাত্যের ভাবনায় সিক্ত ব্রাহ্মরাই প্রথম এগিয়ে আসেন প্লেগের টিকা নিতে।
কলেরার মতোই, গুটিবসন্তও ছিল কলকাতার আর এক দুর্দম শত্রু। ১৮৪৯-এ এ শহরে মোট যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার ১৩ শতাংশ ছিল বসন্তের শিকার। তার পরের বছর স্মলপক্স কমিশনার জানান, ১৮৩২ থেকে ১৮৫০, এই আঠারো বছরের মধ্যে বসন্ত প্রাণ কেড়েছে কলকাতার ১৩৪১১ জন মানুষের। ১৮০২ সালে এডওয়ার্ড জেনার-এর টিকা চলে আসে ভারতে। ওই বছর ১৪ জুন তৎকালীন বোম্বাইয়ে বছর তিনেকের ছোট্ট মেয়ে আনা ডাস্টহলকে দেয়া হয় প্রথম ভ্যাকসিন।
কিন্তু জেনার-এর ভ্যাকসিন কলকাতায় এলে খেপে উঠলেন শহরের বৈদ্যরা। হিন্দুদের কাছে পবিত্র বলে বিবেচিত গরুর রোগের জীবাণু সুস্থ হিন্দুর শরীরে ঢোকানো হবে বলে নয়। আসলে বহু কাল আগে থেকেই এ দেশে দেশীয় পদ্ধতিতে টিকা দেওয়ার চল ছিল। বসন্তে আক্রান্ত রোগীর শরীরের গুটিকা থেকে সুচের ডগায় পুঁজ নিয়ে তা ঢুকিয়ে দেওয়া হত সুস্থ মানুষের শরীরে। তাতে মানুষটি রোগাক্রান্ত হলেও রোগ ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে মৃত্যু ঘটাতে পারত না। ঝুঁকি ছিল এ কাজে। তা সত্ত্বেও পশ্চিমি টিকার উপরে আস্থা ছিল না মানুষের।
কলকাতা কেন, খোদ বিলেতের মানুষও জেনারের আবিষ্কারকে গোড়ায় আমল দেননি। ১৮৭২-এ টিকাকরণ কর্মসূচির অধিকর্তার প্রধান সহকারী গোপালচন্দ্র মজুমদার জানান, কলকাতার মানুষ পশ্চিমি টিকার কার্যকারিতা সম্পর্কে যথেষ্ট সংশয়ী। অবশ্য প্রগতিশীল ভাবনার ক’জন মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন বিদেশি টিকার সমর্থনে। ১৮৫৭ সালে রামনারায়ণ বিদ্যারত্ন ভট্টাচার্য বলেন, দেশীয় টিকা বসন্তের প্রতিষেধক হিসেবে সফল হতে পারে না। পরামর্শ দিয়েছিলেন বিদেশি টিকার। ১৮৬৮-তে হারাধন বিদ্যারত্ন কবিরাজেরও মত, দিশি বদ্যির চিকিৎসাপদ্ধতি আর চলে না। তবু দেশি পদ্ধতিতে টিকা দেওয়ার কাজে ঢুকে পড়ে কলকাতার অপ্রশিক্ষিত কুমোর, নাপিত, তাঁতিরা— নিজেদের পেশা ছেড়ে, অর্থলোভে। ফল, বসন্ত ছড়াল ব্যাপক ভাবে। শেষে ১৮৭০ সালে ব্রিটিশ সরকার দেশি পদ্ধতিতে টিকাকরণ নিষিদ্ধ করলে, প্রাণরক্ষা হল আসল টিকায়। ছবিতে কলেরার টিকাকরণ, ১৮৮০-১৯০০ সময়কালে।
হেমচন্দ্র ১৫০
আলিপুর বোমা মামলার ‘বোমা’ তৈরির অন্যতম কারিগর তিনি, হেমচন্দ্র কানুনগো (১৮৭১-১৯৫০) (ছবিতে)। তাঁর তৈরি তিনটি বোমার একটি ব্যবহার করেছিলেন ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী, মুজফফরপুরে। আধুনিক বোমা তৈরি শিখতে ইউরোপ গিয়েছিলেন, পাঠ নেন ফরাসি বিপ্লবীদের কাছে, মাদাম কামার অনুরোধে আঁকেন ভারতের জাতীয় পতাকাও। আলিপুর মামলার বিচারে আন্দামানে দ্বীপান্তর, কারামুক্তির পর মেদিনীপুরে স্বগ্রামে ফিরে মন দেন ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফি-চর্চায়। তাঁর লেখা বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা বাংলার সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের অমূল্য দলিল। আজ শুধু তাঁর জন্মদিনই নয়, তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষ পূর্তিও। বাংলার এই বিপ্লবীকে আজ স্মরণ করছে অহর্নিশ পত্রিকা, শুভেন্দু মজুমদারের ‘অস্ত্রগুরু হেমচন্দ্র’ আলোচনায়— ‘অহর্নিশ’-এর ইউটিউব চ্যানেলে।
রকমারি
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় ‘তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছিলেন,’ মনে করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রণববাবুকে নিয়ে এবং জলঘড়ি পত্রিকার (সংখ্যা সম্পাদক: স্বাগতা দাস মুখোপাধ্যায় ও উৎপল ঝা) ক্রোড়পত্রে নবনীতা দেব সেন, সুকান্ত চৌধুরী, স্বপন চক্রবর্তী, অমলকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার দাশ প্রমুখের রচনা— বুদ্ধিমান, অন্তর্মুখী, পরিশ্রমী এক বাঙালির পরিচয়। ‘বাংলার মিষ্টি ও মিষ্টান্নশিল্পী’ নিয়ে অন্য ক্রোড়পত্রটিতে সুকুমার সেন, গৌতম ভদ্রের ধ্রুপদী রচনার পাশে হরিপদ ভৌমিক, উর্বী মুখোপাধ্যায়, অরুণিমা রায়চৌধুরীর লেখায় সুস্পষ্ট মিষ্টি ও বঙ্গসংস্কৃতির অচ্ছেদ্য গ্রন্থিটি। এ ছাড়াও আছে শ্রাবন্তী ভৌমিকের অনবদ্য প্রবন্ধ ‘দাদু যখন শ্রী মণীন্দ্রকুমার ঘোষ’, আর আনিসুজ্জামান, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, দেবেশ রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে স্মরণ-নিবন্ধ।
হোটেল কালী
বার্লিনের গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্রী থেরেসা স্ট্রোয়েটজেস ২০১৮-র অক্টোবরে কলকাতায় এসেছিলেন গ্যোয়টে ইনস্টিটিউটের এক প্রকল্পে। এ দেশের সুরের সঙ্গে নিজের সুর মেলানোর তাগিদে তাঁর আলাপ তিন শিল্পীর— ইলেকট্রনিক মিউজ়িক প্রডিউসার বরুণ দেশাই, শিল্পী ও গীতিকার সুযশা সেনগুপ্ত ও ডাবল বেসিস্ট দেবজিৎ মহলানবিশ। চার জনের ‘জ্যামিং সেশন’-এর ধ্বনিমন্থনে জন্ম ইন্দো-জার্মান অ্যালবাম ‘হোটেল কালী’র। দুই গোলার্ধের সুর-তালের সেতুবন্ধে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সুরস্পর্শ। নামকরণে কালী, অন্তরে আছে ‘ইগলস’ ব্যান্ডের দুনিয়া কাঁপানো গানেরও অনুষঙ্গ। ৪ জুন গ্যোয়টে ইনস্টিটিউট-ম্যাক্সমুলার ভবনের ফেসবুক পেজে বসেছিল অ্যালবাম প্রকাশের আন্তর্জাল-আসর।
বিদায়
পড়াশোনা পটনায়। মেঘনাদ সাহার ছাত্র, পরমাণু বিজ্ঞানী শান্তিময় চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ের পর কলকাতা আসেন এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়। কিছু কাল আমেরিকাবাস, আবার এ শহরে ফেরা, কলেজে পড়ানো। অচিরেই লেখায় মন দেন, প্রেমেন্দ্র মিত্রের মনুদ্বাদশ ও পিঁপড়ে পুরাণ-এর ইংরেজি অনুবাদক এণাক্ষী লিখেছেন বহু ছোটগল্পও। খেলার আসর পত্রিকার বিজ্ঞান বিভাগ পরিচালনা, জনপ্রিয় বিজ্ঞান-সাহিত্য পরমাণু জিজ্ঞাসা রচনা, রবীন্দ্র ও বিদ্যাসাগর পুরস্কার জয়— নানা কৃতিত্ব। ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব পশ্চিম, বিক্রম শেঠের আ সুটেবল বয় বাংলায়। বাংলা কল্পবিজ্ঞানকে আধুনিক করে তোলায় তাঁর অবদান কম নয়। ৮৬ বছর বয়সে চলে গেলেন, গত ২৫ মে।
রবিসমীপে
রবীন্দ্রনাথের সময় শান্তিনিকেতনে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আভাস ছিল, মত ইন্দিরা গাঁধীর। বিশ্বভারতীতে পড়ার সময় দেখেছেন কবি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথাও বলতেন। ১৯৮২-তে ইতিহাসবিদ ও রবীন্দ্র-গবেষক উমা দাশগুপ্তকে দেওয়া ইন্দিরা গাঁধীর সাক্ষাৎকারে মেলে এ তথ্য। মৈত্রেয়ী দেবী, রাণী চন্দ, শান্তিদেব ঘোষ, সত্যজিৎ রায়-সহ শান্তিনিকেতনের বহুবিশ্রুত প্রাক্তন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন উমা। তাঁর খাতা, চিঠি, বই তিনি দিয়েছেন জীবনস্মৃতি ডিজিটাল আর্কাইভকে, তা থেকেই তৈরি হয়েছে জীবনস্মৃতির সাক্ষাৎকার পুস্তিকা সিরিজ: ১, সম্প্রতি প্রকাশ করলেন সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখিকার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অরিন্দম সাহা সরদার।
জীবনশিল্প
আঁধারের সময়েও কি গান হবে? হবে তো, গান হবে— আঁধারসময়েরই গান। যে কথা একদা লিখে গিয়েছেন বের্টোল্ট ব্রেশট, অতিমারি আচ্ছন্ন এই সময়ে বারে বারেই তা ফিরে আসছে শিল্পের বিবিধ পরিসরে, শিল্পীর মননেও। শিল্প ভাবায়, কাঁদায়, আবার মনের আরামের পাশাপাশি হয়ে উঠতে পারে জীবনের আরোগ্য, প্রাণের সহায়। এই ভাবনা থেকেই বরেণ্য শিল্পী যোগেন চৌধুরী কৃত ও স্বাক্ষরিত একগুচ্ছ সেরিগ্রাফ (নীচের ছবিতে তারই একটি) নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে ইমামি আর্ট। ছবিগুলিতে ভাস্বর শিল্পীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য— সূক্ষ্ম রেখার বুনোটে আঁকা দেবতা বা মানবপ্রতিমা, কালো তুলির জোরালো আঁচড়ের সঙ্গে হালকা রঙের প্রায় স্বচ্ছ মসৃণ প্রলেপে ক্যালিগ্রাফিসুলভ ছন্দের স্ফূর্তি। শুধু দেখার নয়, আছে ছবি সংগ্রহের সুযোগও। বিক্রয়মূল্যের নির্দিষ্ট অংশ ব্যয়িত হবে কোভিড-ধ্বস্ত দুর্গত মানুষের পুনর্বাসনে। ‘লিরিক্যাল সেনসিবিলিটিজ়’ নামের এ প্রদর্শনী শুরু হয়েছে গত ৬ জুন, দেখা যাবে আজ পর্যন্ত, সংস্থার ওয়েবসাইটে।
জামাইষষ্ঠী
বছর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বারোটি ষষ্ঠী ব্রতের নাম আলাদা, তাৎপর্যও। জ্যৈষ্ঠ শুক্লা ষষ্ঠীর নাম অরণ্যষষ্ঠী, যা বেশি পরিচিত জামাইষষ্ঠী নামে। উপচার ও রীতিতে যার সঙ্গে প্রকৃতি-বন্দনার গভীর সম্পর্ক, সেই অরণ্যষষ্ঠী কী করে জামাই-আদরের পার্বণ হয়ে উঠল, তা নিয়েও নানা মত। কারও মতে, ঔপনিবেশিক আমলে বিবাহিত শিশুকন্যার স্বামীর মঙ্গলকামনায় মায়েদের হাতে এই ব্রতের শুরু। জ্যৈষ্ঠ কৃষ্ণপক্ষে স্বামীদের দীর্ঘায়ু কামনায় স্ত্রীরা পালন করেন সাবিত্রী চতুর্দশী ব্রত, সেই সূত্র ধরেই জামাইষষ্ঠীরও শুরু, এমনটাও প্রচলিত। উৎস যা-ই হোক, জামাইষষ্ঠী এখন বঙ্গ-সংস্কৃতির অঙ্গ। জামাই-আপ্যায়নের রসিকতা থেকেই জন্ম জলভরা সন্দেশের। রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও আছে জামাইষষ্ঠীর কথা, রেওয়াজ ছিল নতুন জামাইয়ের শ্যালক-শ্যালিকাদের নিয়ে থিয়েটার দেখতে যাওয়ার। সঙ্গী হত ছোটরাও। এ ভাবেই এক জামাইষষ্ঠীর বিকেলে ছোট্ট অহীন্দ্র চৌধুরী ক্লাসিক থিয়েটারে দেখেছিলেন প্রফুল্ল নাটকে ‘যোগেশ’রূপী গিরিশচন্দ্রের অভিনয়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলেছে জামাইষষ্ঠীর ছিরিছাঁদ, করোনাকালে এই নিয়ে দু’বছর উৎসবও ঢিমেতাল। ১৬ জুন সে ভাবেই কাটবে মনে হচ্ছে। ছবিতে পুরনো পঞ্জিকায় কাঠখোদাই ছাপা চিত্রে জামাইষষ্ঠী।
আছে, নেই
বড় বড় দুটো পরীক্ষা এ বছর স্রেফ নেই! অ্যাডমিট গুছিয়ে রাখা, দুরুদুরু কাউন্টডাউন, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বইয়ে চোখ বোলানো, অটো-দাদাদের তুরন্ত পৌঁছে দেওয়ার চাপা উদ্বেগ, ডাব হাতে ভুরু কুঁচকোনো মা-বাবা— নেই! আবার ‘ইস, একটুর জন্য স্টারটা মিস করলি’, ‘অমুককে দেখে শেখো, তোমার মতোই পাঁচটা টিউটর ছিল’— এ সবও শুনতে হবে না। জীবনে কিছু ‘নেই’ থাকা ভাল। ও দিকে ফেসবুকে প্রশ্ন ঘনিয়েছে, নোটবই-বিজ্ঞাপনগুলো কি এ বার ‘আছে’ না ‘নেই’?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy