বছর শেষের নিজস্বী। বৃহস্পতিবার রাতে, পার্ক স্ট্রিটে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
রাতের ফুটপাথে বন্ধ শাটারের সিঁড়িতে পড়ে আছে দু’টি অবয়ব। এক জন উপুড়, বেসামাল। আর এক জন হেঁটমুণ্ড উর্ধ্বপদ। ২০১৫-র শেষ দিনটায় সকাল থেকে হোয়াট্সঅ্যাপে ঘুরঘুর করছে ছবিটা। তলায় ‘ক্যাপশন’ ‘দিনের বিশেষ যোগ ব্যায়াম ক্লাস মিস্ করবেন না’! বৌবাজারের সেন্ট জোসেফের গির্জা-চত্বরের পার্টি শেষে বৃহস্পতিবার মাঝরাতের চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ যেন সেই ছবিটাই মনে করিয়ে দিল। শীতের রাতে ধুলোর বিছানায় লুটিয়ে পড়া পার্টিবাজদের ছবিটায় ফেলে আসা বছরটার সব ক্লান্তি মিশে গিয়েছে।
এই মোচ্ছবমত্ত উদ্দাম মেজাজটা সমঝে চলেই সন্ধের পর থেকে শহরে কাজ বেড়েছিল পুলিশের। পার্ক স্ট্রিট, পার্কসার্কাস থেকে সল্টলেক, গড়িয়ার মোড়ে মোড়ে বেপরোয়া বাইকবাজদের ধরতে দাঁড়িয়ে উর্দিধারীরা। যন্ত্র দিয়ে জরিপ করে মত্তদের ‘ঘ্রাণশিকারে’ ব্যস্ত পুলিশ। বেশি ফুরফুরে মেজাজে স্টিয়ারিংয়ে বসলেই রাতটুকু শ্রীঘরে কাটানোর ব্যবস্থা পাকা। দশটা বাজতে না-বাজতেই ধরপাকড় শুরু।
এর আগে অবশ্য বছরের শেষ দিনটার স্বাদ গোগ্রাসে চেটেপুটে খেয়েছে কলকাতা। সকাল ন’টায় কলকাতামুখী লোকাল ট্রেনের ভিড়টা ক্রমশ চিড়িয়াখানা থেকে নিউ টাউনের ইকো পার্ক, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থেকে নিক্কো পার্ক বা মাল্টিপ্লেক্সে হিট সিনেমার লাইনে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনিতে অবশ্য এটা কাজের দিন। সরকারি-বেসরকারি অনেক অফিসই খোলা। কিন্তু পয়লা জানুয়ারি থেকে শুরু করে বছরের প্রথম সপ্তাহান্ত জুড়ে টানা ছুটি। এই মওকায় অনেকেই বেড়াতে যাবেন! তাই বছরের শেষ দিনটা ব্যাগ গুছিয়েই কেটেছে।
রাতের পার্টিতে কে কোথায় জড়ো হচ্ছেন, অফিসে-অফিসে সেই জল্পনাতেও মশগুল ‘কাজের মানুষেরা। নামী-দামি ক্লাব, হোটেলের ‘কনট্যাক্ট’দের মোবাইল বেজে চলেছে ঘনঘন। ইউক্রেনের লাস্যময়ীদের ‘বেলি ডান্স’ কিংবা বলিউডি শিল্পীর মদির কণ্ঠের পরিবেশন— কাটতিতে এ-বলে আমায় দেখ, ও-বলে আমায়! একলা বা দোকলা পার্টিতে প্রবেশের ছাড়পত্রের দক্ষিণা, ৮-১০-১৫ হাজারের সীমা পার করে যাচ্ছে।
বাড়ির বাইরে গাঁটের কড়ি গচ্চা দিয়ে ‘মস্তি’র মু়ড নেই যাঁদের, তাঁদের পার্টির আয়োজন অবশ্য কোনও বন্ধুর ফ্ল্যাটেই ঘটছে। রাতের পার্টির সেই ‘কমরেডরা’ সকাল থেকেই হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে খুনসুটিতে মশগুল। বাইপাসের ধারের ফ্ল্যাটে জমায়েতের মেনুতে পর্ক ভিন্দালুর ম্যারিনেশনের হাল-হকিকত নিয়ে দফায় দফায় ‘আপডে়ট’ চলছে। শেষ মুহূর্তে পানীয়ের ‘রেশন’ নিয়ে পরিকল্পনায় অল্প রদবদল-কথা ভেসে আসছে ঘনঘন। নরক গুলজারের আয়োজন সারা বিকেলের মধ্যেই।
পার্টি-পাগলামির এই কলকাতার বাইরে অন্য একটা কলকাতাও অবশ্যই আছে। গঙ্গার ধারের নৌবিহারে ভরবিকেলে সে নিজের মতো করে নির্জনতা খুঁজেছে। কিংবা ইকো-পার্কের কায়্যাকিংয়ের আসরে মেতেছে। হাল্কা শীতের আমেজে মেলার মজাও রাতের পার্টির থেকে কিছু কম নয়। যোধপুর পার্কে ইইডিএফ সংলগ্ন মাঠে খাদির মেলায় দেদার বিকোচ্ছে জয়নগরের মোয়া। কনকচূড় ধানের মুখে মিলিয়ে যাওয়া খইয়ে নলেন গুড়ের ঘ্রাণের মাদকতার ঘোরও মদিরার থেকে কম যায় না। বর্ধমানের কাঠের পুতুল, বাঁকুড়ার ডোকরা-শিল্প থেকে কালিম্পংয়ের কেক নিয়ে মাতামাতিও কম নয়। ২০১৫-র শেষ দিনে কোনও কোনও বাঙালি যেন সুদূর অতীতময়। বহরমপুরের ৫০০ কাউন্টের ফিনফিনে মসলিনের এক কিলোমিটার লম্বা থান আংটির ফাঁকে গলে যায় দেখে কবেকার ইতিহাসের গালগল্পে ডুব দিয়েছেন ভদ্রজন।
বছরের শেষ সন্ধেটা মেজাজে কাটাতে দুপুর থেকেই ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’-এর বার্তা লিখে রঙিন কাগজের শিকলিতে সেজে তৈরি ছিল শহরের পানশালাগুলো। অফিসপাড়ায় চাঁদনি চক স্টেশনের কাছের চেনা পানশালায় ফটকে পরিচিত কর্মচারী হঠাৎ প্রয়াত ‘সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়ে’র ছবিটা দেখেও তৃষ্ণার্তরা অনেকেই চমকে উঠেছেন। চলকে ওঠা পানীয়ের গ্লাসে স্খলিত হওয়ার ফাঁকে ‘কবে’, ‘কী করে’, প্রশ্নগুলোও চেনা নেশাড়ুদের বিঁধে চলেছে। বো স্ট্রিটে বড়ুয়াদের বিখ্যাত কেকের দোকানের ‘মন্টুদা’ও তো এই বছর থেকে শুধুই ছবিতে। পয়লা জানুয়ারির কেক কিনতে এসে চেনা খদ্দেররা মন্টুদার খোঁজ করতে গিয়ে ছবির ফ্রেম দেখেই স্তব্ধ!
এমন কয়েকটা ছবির ফ্রেমেই এখন ‘ফ্রিজ শট’ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাতিল ক্যালেন্ডারের ২০১৫! তাকে ‘টা-টা’ করে স্খলিত ফুরফুরে মেজাজের উদ্দাম কলকাতা ভেঁপু বাজিয়ে সিটি-র উল্লাসে ২০১৬-কে বরণ করে নিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy