ঐতিহাসিক: খিদিরপুর ডকের ঘড়ি টাওয়ার। নিজস্ব চিত্র
চিরকালের মতো ভিটেমাটি ছেড়ে পরবাসী হওয়ার আগে তাঁদের শেষ পদচিহ্ন পড়েছিল এ শহরের গঙ্গার তীরে। খিদিরপুরের বন্দর থেকেই জাহাজে চেপে বিদেশ পাড়ি দিতেন তাঁরা। ‘দেশত্যাগের’ বহু বছর পরে সেই মানুষগুলির ইতিহাসকেই ফিরে দেখতে চাইছেন কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার খিদিরপুর ২ নম্বর ডকে একটি অনুষ্ঠানে উঠে এল সেই প্রসঙ্গ।
কলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যান বিনীত কুমার ওই অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, ‘ভোপাল’ নামে একটি বহু পুরনো স্টিমারকে তাঁর ঐতিহ্য বজায় রেখে মেরামত করা হচ্ছে। তার ভিতরেই এই সম্পর্কিত একটি সংগ্রহশালা তৈরি করা হবে। তিনি বলেন, ‘‘আশা করছি, চলতি বছরেই সেই সংগ্রহশালার উদ্বোধন করা যাবে।’’ ওই ডকের কাছেই শতাব্দীপ্রাচীন একটি ঘড়ি-স্তম্ভ রয়েছে। নিয়মিত দেখাশোনা করায় তার কাঁটা এখনও সচল।
শুধু সংগ্রহশালা নয়, ঔপনিবেশিক আমলে পরবাসী হওয়া ওইসব মানুষের ইতিহাসকে ভিন্ন ভাবে বিশ্লেষণের কথাও জানিয়েছেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত মার্কিন ইতিহাসবিদ জেরাল্ডিন ফোর্বস। তাঁর মতে, সে সময়ে ঔপনিবেশিক শাসকেরা এমন পরিস্থিতি তৈরি করতেন, যাতে বাধ্য হয়ে গরিব মানুষেরা কাজের খোঁজে দেশ ছেড়ে যেতেন।
ইতিহাস বলছে, ব্রিটিশ আমলে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছিল ভারত ছেড়ে কাজের খোঁজে যাওয়া মানুষ। তবে সেই জনগোষ্ঠীর বিদেশযাত্রা মোটেও সুখের ছিল না। বিদেশি শাসক ও বণিকদের ‘বাঁধা শ্রমিক’ হিসেবে ত্রিনিদাদ, জামাইকা, ফিজি, মরিশাস, মালয়েশিয়ায় পাড়ি দিতে খিদিরপুর ২ নম্বর ডক থেকেই জাহাজে উঠতেন তাঁরা। ইতিহাসবিদেরা জানান, ১৮৩৩ সাল থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে প্রায় ১২ লক্ষ শ্রমিক পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের স্মৃতিতে ২০১১ সালে একটি স্মারকস্তম্ভও বসানো হয়।
সে সময়ে জীবিকার খোঁজে ঘরবাড়ি ছেড়ে বাঁধা শ্রমিক হিসেবে বিদেশ-যাত্রা করতেন বাংলা, বিহার-সহ উত্তর ভারতের বহু মানুষ। কিন্তু সেখানে গিয়ে কি আদৌ সুখে থাকতেন? ইতিহাস বলছে, খাতায়-কলমে চুক্তিভিত্তিক বা বাঁধা শ্রমিক হলেও আদতে তা দাসত্বের থেকে কিছু কম ছিল না। বিদেশে কুলি-শ্রমিকের কাজ করতে গিয়ে অত্যাচারে, নিপীড়নে অনেকেই প্রাণ হারাতেন। কাজ ছেড়ে পালাতে চাইলে অনেক সময়ে কুঠুরিতে আটকে রাখা হত তাঁদের। প্রথম দিকে পুরুষেরা শ্রমিক হিসেবে বিদেশ গেলেও পরে কাজের খোঁজে দেশ ছাড়তেন বহু গরিব বিধবা, সমাজচ্যুত মহিলারাও। তবে নতুন দেশে গিয়ে মালিকপক্ষের যৌন নির্যাতনের শিকার হতেন তাঁদের অনেকেই। মালিনী সিংহের গবেষণায় কুন্তী নামে এমনই এক চরিত্র উঠে এসেছে।
ফোর্বস জানান, ১৯১৫ সালে সি এফ অ্যান্ড্রুজ় ফিজিতে গিয়ে দেখেছিলেন, সেখানে শুধুই পুরুষ শ্রমিকেরা কাজ করেন। আর সংসার ও সঙ্গীহীন সেই পুরুষদের অনেকেই অবসাদে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। পরবর্তী কালে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। ফোর্বস জানাচ্ছেন, সে সময়ে বিদেশের মাটিতে ভারতীয় সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছিল এই শ্রমিকদের হাত ধরেই। তিনি জানান, দেহাতি শ্রমিকেরা বিদেশে গিয়ে অবসরে ভোজপুরি লোকসঙ্গীত, ‘চাটনি গান’ গাইতেন। বংশানুক্রমে সেই সুরই এখন ক্যালিপসো বা সালসায় ঢুকে পড়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy