Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪

ক্ষয়িষ্ণু বাড়ির গভীরে ইতিহাসের শিকড়

দিনটি ছিল ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৭৫৭। তার চার মাস পরেই পলাশির প্রান্তরে পরাজিত হবে সিরাজের বাহিনী। গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হবেন পলায়নরত সিরাজ।

ঐতিহাসিক: ক্লাইভ হাউসের ভগ্নপ্রায় খিলান

ঐতিহাসিক: ক্লাইভ হাউসের ভগ্নপ্রায় খিলান

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৮ ০২:১২
Share: Save:

ফেব্রুয়ারির কুয়াশামাখা সকাল। বাহিনী নিয়ে রবার্ট ক্লাইভ চলেছেন শিয়ালদহে, নবাব সিরাজের শিবিরে। হঠাৎই নজরে পড়ল একতলা বাড়িটি। চারধার থেকে বেশ কিছুটা উঁচুতে ঢিবির উপরে, যেন বিলেতের ছোঁয়া রয়েছে ওই বাড়িতে।

দিনটি ছিল ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৭৫৭। তার চার মাস পরেই পলাশির প্রান্তরে পরাজিত হবে সিরাজের বাহিনী। গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হবেন পলায়নরত সিরাজ। ক্ষমতায় এসে ওই ঢিবির উপরের বাড়িটি দখলে নেবেন ক্লাইভ। আরও একতলা বাড়িয়ে মনের মতো করে সাজিয়ে তুলবেন সেটি। নাম দেবেন ‘ক্লাইভ হাউস’। যেটি ‘বড়া কোঠি’ নামেও পরিচিত।

ক্লাইভ হাউসের আদি মালিকানা কার ছিল তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু ওই বা়ড়ি ক্লাইভ হাউস হয়ে ওঠার কাহিনি পাওয়া যায় ইতিহাসবিদ রবার্ট ওরমের ‘হিস্ট্রি অব দি ওয়ার ইন বেঙ্গল’ বইয়ে। লুইস ও’ম্যালি নামে এক আমলাও ১৯১১ সালে ২৪ পরগনার গেজেটিয়ারে ক্লাইভের হাতে বাড়িটি সংস্কারের কথা লিখেছেন। তাঁর মতে, এই বাড়ি বাংলার প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন।

বহু ইতিহাসের সাক্ষী সেই বাড়ি আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে নাগেরবাজারের রাষ্ট্রগুরু অ্যাভিনিউয়ে। ক্ষয়রোগে ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া বাড়িটি দেড় দশক আগে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ সারানোর দায়িত্ব নেয়, কিন্তু শুরু থেকেই সে কাজ থমকে গিয়েছে।

ঐতিহ্যের গায়ে জমিয়ে গেরস্থালি। (ইনসেটে) মার্বেল ফলকে খোদাই করা ক্লাইভের নাম।

ইতিহাসবিদদের একাংশ বলেন, ক্লাইভ হাউসের লাগোয়া উঁচু মাঠ বা ঢিবি থেকেই নিজের নাম খুঁজে পেয়েছে দমদম। সেনাদের চাঁদমারির উঁচু মাঠকে বলা হয় ‘দমদমা’। সেখানেই গোরাদের নিশানাবাজি চলত। তা থেকেই দমদম নাম।

পুরনো বাসিন্দারা বলছেন, ঢিবির উপরে ভাঙাচোরা বা়ড়িটা নিয়ে ভূতের গুজবও কম নেই। এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি বলছেন, ‘‘ছোটবেলায় পিসিকে নিয়ে ওই ঢিবি পেরিয়ে ক্লাইভ হাউসে বেড়াতে যেতাম। কিন্তু সূর্য ঢলে পড়ার আগেই পিসি টেনে নামিয়ে আনত। ফেরার আগে দেখতাম, কাকে যেন প্রণাম ঠুকত পিসি।’’ দু’দশক আগেও ওই ঢিবির মাঠে বিকেলে ফুটবল-ক্রিকেটের আসর বসত। কেউ কেউ রোমাঞ্চের নেশায় ভগ্নস্তূপে উঁকিও দিত। ‘‘এ ভাবেই এক দিন বিরাট ভাঙা গেটের পাশে লতানে গাছের আড়ালে দেখলাম মার্বেলে লেখা ক্লাইভের নাম!’’— বলছেন এক যুবক।

ঐতিহাসিক নথি বলছে, ক্লাইভের পরে হাতবদল হয়েছে বাড়িটির। ১৮২০ সালে এ বাড়িতে ক’দিন কাটিয়েছেন বিশপ হেবার নামে এক পাদ্রি। একটি গোরা পল্টনের সদর দফতরও ছিল এটি। ১৮৯১ সালে তারা সরে যাওয়ার পর থেকে বাড়িটি ভাড়া দেওয়া হত। স্যর ওয়েন জেনকিন্স নামে এক সাহেব ব্যবসায়ী তাঁর ‘মার্চেন্ট প্রিন্স, মেমোরিজ অব ইন্ডিয়া ১৯২৯-১৯৫৮’ নামে স্মৃতিকথায় লিখেছেন, তিনি ক্লাইভ হাউসেই থাকবেন বলে স্থির করেছিলেন। কিন্তু বাড়ির কাছের বাজারের দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে পালান।

অর্ধসমাপ্ত সংস্কার কাজ।

নাগেরবাজারের পুরনো বাসিন্দারা জানান, দেশভাগের পরে ব্রিটিশ চলে গেলে বা়ড়িটি মালিকানাহীন হয়ে পড়ে। সে সময়ই এখানে আশ্রয় নেন পূর্ববঙ্গ থেকে আসা কয়েকটি উদ্বাস্তু পরিবার। সাহেবের সাধের বা়ড়ি চলে যায় ‘নেটিভ’-দের দখলে। পরবর্তী কালে ওই বাড়ির একাংশেই আবার গজিয়ে উঠেছিল বিমান মেরামতির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। পরে অবশ্য তারা সরে যায়।

২০০১ সালে দমদমের ইতিহাসকে নতুন ভাবে তুলে ধরে ক্লাইভ হাউস। সে বছরই ওই ঢিবি থেকে পুরনো মাটির ভাঙা পাত্র পাওয়া যায়। তা দেখে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ। পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ জানিয়েছে, ওই ঢিবি থেকে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে অষ্টম-নবম শতাব্দীর মৃৎপাত্র, মুদ্রা-সহ নানা জিনিস মিলেছে। ফলে দমদমের ইতিহাসের শিকড় ক্লাইভ সাহেবে নয়, আরও গভীরে।

ছবি: শৌভিক দে

অন্য বিষয়গুলি:

Clive House Heritage
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy