বিস্মৃতি: এই সেই ‘ওল্ড দমদম রোড’। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
কেউ জানেন কি দক্ষিণ দমদম পুর এলাকার নাগেরবাজার মো়ড়ের মসজিদটির বয়স কত? ইতিহাস বলছে, টিকে থাকা ওই মসজিদ মুঘল আমলের। সিরাজউদ্দৌলারও যাতায়াত ছিল সেখানে। কিন্তু সে তথ্য অন্ধকারেই ঘুমিয়ে রয়েছে।
এ ভাবে ঘুমিয়ে থেকেই চিরনিদ্রায় চলে গিয়েছে কলকাতার চেয়েও প্রাচীন শহর দমদমের ইতিহাস। অথচ দমদমের পরতে পরতে জড়িয়ে বহু কাহিনি। পলাশির যুদ্ধের কিছু কাল আগের কথা। সেনাবাহিনী নিয়ে যশোর রোড ধরে কলকাতার দিকে মার্চ করছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসার রবার্ট ক্লাইভ। দমদমে পৌঁছে রাস্তার বাঁ দিকে দু’টি বাড়ি চোখে পড়েছিল তাঁর। কিছু দিনের মধ্যেই সেই দু’টি বাড়ির দখল নেয় ক্লাইভের সৈন্য। ক্লাইভ হাউস নামে যার একটি এখনও অবশিষ্ট। পুরনো ওই বাড়ি সংস্কারও করেছিলেন ক্লাইভ।
কয়েকশো মিটার দূরেই ছিল অন্য বাড়িটি। যা তৈরি করেছিলেন নবাব আলিবর্দি খান। সেই বাড়িটিরও সংস্কার করেছিলেন ক্লাইভ। নাম হয়েছিল ‘ফেয়ারি হাউস’। বরের উপর রাগ করে ক্লাইভের স্ত্রী নাকি সেখানেই স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। এখন অবশ্য সে বাড়ির অস্তিত্ব নেই। বাম আমলে বাড়িটি বদলে হয়েছিল অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরি। বছর কয়েক আগে ইতিহাসের কবর খুঁড়ে সেখানে তৈরি হয়েছে বিশাল আবাসন।
বছর আঠেরো আগে আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার খননকার্যে অস্তিত্ব মেলে, দমদমে ছড়িয়ে ছিল মুঘল আমলের থেকেও পুরনো সভ্যতা। সে সব সামনে আসার বহু আগেই একে একে ধ্বংস হয়েছে দমদমের ঐতিহাসিক ইমারত, সৌধ।
শহরের প্রথম করণিক ভবন বা রাইটার্স বিল্ডিং তৈরি হয়েছিল দমদম অঞ্চলেই। কোম্পানির আমলে তৈরি দমদম-কলকাতা অঞ্চলের সেই রাইটার্স বিল্ডিং ভেঙে এখন উঠেছে আবাসন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মাল্যদান’ গল্প অবলম্বনে তৈরি ছবিটির শুটিং হয়েছিল নাগেরবাজার মোড়ের ‘তাজমহল’ স্টুডিয়োয়। শোনা যায়, সেখানে শুটিং দেখতে গিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। স্টুডিয়োটির অস্তিত্ব আজ আর নেই। এমনকী কেউ জানেনও না তার পুরনো ঠিকানা।
বিশেষজ্ঞেরা বলেন, কখনও কখনও ইতিহাসের অসচেতনতাও বাঁচিয়ে দেয় গুরুত্বপূর্ণ দলিল। ‘ওল্ড দমদম রোড’ সম্ভবত তেমনই এক রাস্তা। বর্তমান দমদম রোডের সেভেন ট্যাঙ্কস স্টপেজে নেমে নর্দার্ন অ্যাভিনিউয়ের যে রাস্তাটি ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড পর্যন্ত এঁকেবেঁকে গিয়েছে, সেটি মুঘল আমলে তৈরি। অধিকাংশ মানুষই তা জানেন না। দমদম গবেষক গৌর মৌলিকের দাবি, ১৮৩০ এবং ১৮৭০ সালের ম্যাপেও ওই রাস্তা ‘ওল্ড দমদম রোড’ বলে চিহ্নিত হয়েছিল। সম্ভবত ১৯৩৬ সালের ম্যাপে রাস্তাটি শেষ বারের মতো ‘ওল্ড দমদম রোড’ বলে চিহ্নিত হয়। বড় বড় গাছে ঢাকা সেই রাস্তা এখন উমাকান্ত সেন লেন নামে পরিচিত। গৌরবাবুর কথায়, ক্লাইভই স্থির করেছিলেন পুরনো আঁকাবাঁকা রাস্তাটির পরিবর্তন ঘটিয়ে সোজা এবং চওড়া রাস্তা হবে। পরবর্তী কালে তা মেনেই নতুন দমদম রোড তৈরি করেন টমাস ডিন পিয়ার্স।
অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি, কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরি, কয়েকটি চার্চ, গোরাবাজারের টমাস ডিন পিয়ার্সের সৌধ, মিলিটারি বারাক (যা এখন সেন্ট্রাল জেল), নাগেরবাজার মোড়ের মসজিদের মতো কিছু পুরনো সৌধ এখনও ইতিহাস কাঁধে নিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে প্রাচীন দমদমকে।
দীর্ঘদিন ধরে কলকাতা শহরের হেরিটেজ রক্ষা নিয়ে আন্দোলন করছেন লেখক অমিত চৌধুরী। দমদমের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘‘এ রাজ্যে হেরিটেজ রক্ষা সংক্রান্ত আইনগুলি পরিষ্কার নয়। হেরিটেজ কমিটিরও কোনও মাথাব্যথা নেই। নতুন আইনের জন্য আন্দোলন করতে হবে। বুঝতে হবে, হেরিটেজের অর্থ একটা-দুটো বাড়ি রক্ষা করা নয়, একটা সময়কে রক্ষণাবেক্ষণ করা। সেটা হয়নি বলেই আজ দমদমের এই অবস্থা।’’ অমিত চৌধুরীর আক্ষেপ, প্রাগে যা সম্ভব, নেপালের ভক্তপুরে যা সম্ভব, এমনকি মুম্বইয়েও যা সম্ভব, কলকাতা শহর তা এখনও ভাবতেই পারেনি। তৈরি হয়নি কোনও হেরিটেজ জোন। সেটা করা গেলেই দমদমের মতো বহু অঞ্চলকে বাঁচিয়ে রাখা যেত। ইতিহাস নিয়ে বাঙালির চূড়ান্ত অসচেতনতা এ জন্য দায়ী। গৌরবাবুর আক্ষেপ, এ শহরের
মানুষ যত দিনে সচেতন হয়ে উঠবেন, তত দিনে হয়তো এই দমদমের ইতিহাসের আর কিছুই অবশিষ্টই থাকবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy