দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে এলেন ১৯১৫ সালের জানুয়ারিতে, আর তার পর ফেব্রুয়ারি ও মার্চ দুই মাসেই পর পর দুই বার এলেন শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমে। তখন থেকেই কি বাংলা ও বাঙালি আলাদা জায়গা করে নিয়েছিল তাঁর মনে? হতেই পারে। যত বারই তিনি পা রেখেছেন বাংলায়, প্রকাশ পেয়েছে বেশ একটা আবেগ। এই যেমন, ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরে যখন এলেন, আবারও গেলেন শান্তিনিকেতন, আর বললেন, বিশ্বভারতীই বুঝিয়ে দেয়, সত্যিকারের ‘মনুমেন্ট’ আসলে কোনও মার্বেল, ব্রোঞ্জ বা সোনার স্ট্যাচু নয়— আসল স্মারকস্তম্ভ সেটাই যা ঐতিহ্যকে মনে করায়, ঐতিহ্যকে সজ্জিত এবং প্রসারিত করে: ‘‘দ্য বেস্ট মনুমেন্ট ইজ় টু অ্যাডর্ন অ্যান্ড এনলার্জ দেয়ার লেগ্যাসি।’’
তবে কি গাঁধীর এই বাঙালি-প্রীতির বিশেষ কারণ রবীন্দ্রনাথ? নিঃসন্দেহে। এক ‘‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো’’ গানটিই যে কত বার তাঁকে কত সঙ্কটমুহূর্তে আশ্রয় দিয়েছে, সে কথা ইতিহাসই জানে। তাঁর অনশনভঙ্গের সময়েও সামনে বসে এই গান গাইতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে। অবশ্য তা ছাড়াও বাংলার মানুষ তাঁকে আকৃষ্ট করত, বাংলাদেশের পরিবেশও। ১৯৪৭ সালে নোয়াখালির রাস্তায় একক নিষ্ঠা ও দুঃসাহসের প্রতিমূর্তি গাঁধীজি হেঁটে যাচ্ছেন যখন, তখনও মনে করেছেন, সেই অসহযোগ আন্দোলনের যুগে আলি-ভাইদের সঙ্গে পুব বাংলায় প্রথম সফরের কথা। অদ্ভুত একাত্মতায় বলছেন, ‘‘আই ক্লেম টু বি অ্যান ইন্ডিয়ান, অ্যান্ড, দেয়ারফোর, আ বেঙ্গলি, ইভন অ্যাজ় আই অ্যাম আ গুজরাটি।’’
১৯৪৬ সালের নভেম্বরে কলকাতার সন্নিকটে শ্রীরামপুরে থাকলেন কিছু দিন, আর রোজ নিয়ম করে বাংলা শিখতে শুরু করলেন (বাঁ দিকের ছবিতে ১৯৪৭-এর কলকাতায় মহাত্মা গাঁধী)। কাকডাকা ভোরে উঠে বাংলা-শেখার পর্ব শুরু। কেন? কেন তাঁকে বাংলা শিখতে হবে? কেননা, বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর অসীম শ্রদ্ধা। ‘‘বাংলা তো শুধু রবীন্দ্রনাথ আর বঙ্কিমচন্দ্র তৈরি করেনি, বাংলা তৈরি করেছে সেই চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সাহসী নায়কদের, যতই তাঁরা আমার চোখে বিপথগামী হোন না কেন।’’ বাংলার মানুষ সম্পর্কে তাঁর একটা অদ্ভুত উচ্চাশা ছিল, তিনি যেন ভাবতেই পারতেন না ভারতের এই প্রদেশটিতে কোনও ‘মূর্খামি’ কিংবা ‘ভীরুতা’ থাকতে পারে— অন্যত্র যা-ই ঘটুক না কেন। ১৯৪৬ সালের অগস্ট মাসের কলকাতা ও তার পরে নোয়াখালির হিন্দু-মুসলমান হিংস্রতা তাই হয়তো তাঁকে অসুস্থ করে ফেলেছিল। দেড় মাস পর নিজের জন্মদিন ২ অক্টোবরেও তাঁর কাতর আর্তি, ‘‘কবে শেষ হবে এই পাশবিক উল্লাস?’’
১৯৪৭ সালের মে মাসে গাঁধীজি কলকাতার কাছেই সোদপুরে ছিলেন কিছু দিন। ভেবে দেখছিলেন, বাংলাকে কী ভাবে রাজনীতির করাল গ্রাস থেকে বাঁচানো যায়। শরৎচন্দ্র বসু, আবুল হাশিম আর হোসেন শহিদ সুরাবর্দি, তিন উৎকণ্ঠিত বাঙালি নেতাকে বলছিলেন, অনেক দিন ধরে তো তিনি চেষ্টা করছেন বাঙালি হওয়ার জন্য। বাংলা শিখতে চাইছেন যাতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা বাংলাতেই পড়তে পারেন— উপনিষদের মূল ভাব, ভারতীয় সভ্যতার গৌরব তো রবীন্দ্রনাথই ধরে রাখতে পেরেছেন। সেই সময়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও সোদপুরে ছুটে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। গাঁধী তখনও ভাবছেন, বাঙালি হিন্দু-মুসলমান এক হয়েই হয়তো দেখিয়ে দেবে জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্ব আর পাকিস্তান পরিকল্পনা কত বড় ভুল। বাংলা যে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির মাতৃভাষা— মনে করাচ্ছেন বাংলা ভাষার নতুন ছাত্র, গাঁধী। বাংলা ভাষা ও বাঙালি তাঁর কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলেই কি স্বাধীনতা ও দেশভাগ ঘোষণার চূড়ান্ত দিনটি তিনি কাটালেন সেই কলকাতাতেই? বেলেঘাটার বাড়িটি (ছবিতে ডান দিকে) থেকে গেল ইতিহাস হয়ে। এক বিরাট ট্র্যাজেডির প্রেক্ষাপটে দুঃসহ একাকী নায়কের আশ্রয় হয়ে।
প্রকৃতিবিজ্ঞানী
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যকে (১৮৯৫-১৯৮১) বলা হয় বাংলার প্রথম এথোলজিস্ট বা প্রাণী-আচরণতত্ত্ববিদ। এই মানুষটিই ১৯৬৮ সালে পেয়েছিলেন আনন্দ পুরস্কার, ১৯৭৫-এ রবীন্দ্র পুরস্কারও। তাঁর জীবন ও কাজ নিয়ে ১২ সেপ্টেম্বর ওয়েবিনার আয়োজন করেছিল ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স, এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, কলকাতা-র ক্যাম্পাস রেডিয়ো, বক্তা কলকাতার বসু বিজ্ঞান মন্দিরের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী গৌতম বসু। ছবি ও স্লাইডে বাংলায় প্রকৃতিবিজ্ঞান চর্চা ও গোপালচন্দ্রের গবেষণার কাহিনি তুলে ধরলেন তিনি। গোপালচন্দ্রের লেখা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ, তাঁকে নিয়ে লেখা বইয়ের হদিশও পাওয়া গেল, দেখা গেল তাঁর তোলা বাংলার কীটপতঙ্গের দুষ্প্রাপ্য ছবিও।
তাঁকে মনে রেখে
২৬ সেপ্টেম্বর সমগ্র বঙ্গভূমি তাঁর স্মৃতিতে প্রণত। গ্রন্থ ও পত্রিকা প্রকাশ, আলোচনা, সমাজসেবামূলক কাজ অবিরল। বিদ্যাসাগরের জন্মের দুশো বছরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটান ইন্সটিটিউশন, এখনকার বিদ্যাসাগর কলেজে আগামী কাল বিকেল ৫টায় আলোচনাসভা, প্রকাশিত হবে কলেজের শিক্ষক সংসদের পত্রিকা ‘প্রসপেক্ট’-এর বিদ্যাসাগর সংখ্যার ই-সংস্করণ। সেখানে তাঁর সংস্কৃত কলেজে চাকরির আবেদনপত্র, পদত্যাগপত্র, আইন পাশের শংসাপত্রের ছবি ও প্রতিলিপি ছাড়াও রয়েছে শিবনাথ শাস্ত্রী, যোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়, সরোজকুমারী দেবী, মানকুমারী বসু, উমাশশী দেবী, রমেশচন্দ্র দত্ত এবং রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাসাগর-বিষয়ক লেখার পুনর্মুদ্রণ।
সময়োচিত
গোয়েবলস ১৯৩৩ এবং শব্দ আর সত্য, শঙ্খ ঘোষের এই কবিতা ও গদ্যের উদ্ধারে, বর্তমানের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতাকে বুঝতে ‘প্রতিবাদী মন আর সম্যক কাব্যিক উপলব্ধি’র কথা উঠে এসেছে অনুষ্টুপ পত্রিকার ‘গ্রীষ্ম-বর্ষা ও প্রাক্-শারদীয় যুগ্মসংখ্যা’-র সম্পাদকীয়তে। ‘সাম্প্রতিক সাংস্কৃতিক সমাচার’-এ আছে দেরিদার নব্বইতম জন্মদিনে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের বক্তৃতার অনুলিখন-সহ আরও ছ’টি লেখা; ‘প্রয়াণলেখ’ অংশে আনিসুজ্জামান, হরিশঙ্কর বাসুদেবন, বাসু চট্টোপাধ্যায় ও বিস্মৃত গীতিকার যোগেশ গওরকে স্মরণ। বঙ্কিমচন্দ্রের হিন্দুত্ব, মার্ক্সবাদের বহুমার্গতা থেকে ঔপনিবেশিক বঙ্গে যৌন-নৈতিকতা, আধুনিক দলিত মহিলাদের আত্মজীবনী ও বিবর্তন— প্রবন্ধগুলির বিস্তার অনন্য। কবিতা ও গল্পের পাশে প্রধান আকর্ষণ তিনটি ক্রোড়পত্র— বিদ্যাসাগর, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও কোভিড-১৯ অতিমারি নিয়ে। ‘গ্রন্থভাবনা’র গদ্যগুলিও সুখপাঠ্য।
নানা ভূমিকায়
‘‘মানিকদা কেন আমাকে সীমাবদ্ধ ছবিতে শ্যামলেন্দু চরিত্রে নিয়েছিলেন, জানাননি কখনও,’’ বলছিলেন অভিনেতা বরুণ চন্দ, ‘‘ছবি রিলিজ়ের পরে এক দিন বিজয়া রায় বলেছিলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, সৌমিত্র (চট্টোপাধ্যায়) করবে চরিত্রটা। কিন্তু মানিক এক রাতে বলল, না, নতুন এক জনকে নেব ঠিক করেছি’।’’ সত্যজিতের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ১৯ সেপ্টেম্বর ওয়েবিনার আয়োজন করেছিল দ্য ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো সেন্টার ইন দিল্লি, সহায়তায় প্রহর ডট ইন। শিকাগো ডায়লগস-এর প্রথম পর্ব দ্য রে লেস ট্র্যাভেলড-এর সূচনা করে ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী সঞ্চালনার দায়িত্ব দিলেন অভীক চন্দকে। আলোচনা হল সত্যজিতের সত্তর দশকের শহর-ট্রিলজি প্রতিদ্বন্দ্বী, সীমাবদ্ধ, জনঅরণ্য নিয়ে। ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো-র শিক্ষক, ভারতের শিল্পিত সিনেমার সাংস্কৃতিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণারত রোচনা মজুমদার বললেন, ছবিগুলিতে সত্যজিতের ভূমিকা যেন এক এথনোগ্রাফার বা ডকুমেন্টারিয়ান-এর।
লেখা রবে
১৯৮৯-এর ২৬ সেপ্টেম্বর চলে গিয়েছেন তিনি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ‘‘তবু তাঁকে ছাড়া একটি দিনও কাটে না’’, বলছিলেন সৌম্যেন অধিকারী। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্মরণ কমিটি’-র সম্পাদক তিনি, কৈশোর থেকে হেমন্তের স্নেহধন্য, উদ্যমী হেমন্ত-গবেষক ও সংগ্রাহক। শিল্পী রেকর্ড বা ক্যাসেটে কোথায় কী গেয়েছেন, লিখে রাখতেন খাতায়। হেমন্তের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের কালানুক্রমিক সূচি তৈরির কাজে রবীন্দ্র-গবেষক সুভাষ চৌধুরীকে তাঁর সাহায্য নেওয়ার কথা বলেছিলেন শিল্পী স্বয়ং। হেমন্ত-স্মরণে দেশে-বিদেশে গান গেয়েছেন সৌম্যেন, সংগ্রহ করে চলেছেন গান ছবি চিঠি নথি। হেমন্তের প্রয়াণের পর বেলা মুখোপাধ্যায় গড়েছিলেন ‘হেমন্ত স্মৃতি সংসদ’, তারই পরম্পরায় সক্রিয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্মরণ কমিটির উদ্যোগে এ বছর প্রকাশিত হয়েছে হেমন্ত শতবর্ষ স্মারক সংখ্যা। বর্ষব্যাপী অনুষ্ঠানের ইচ্ছে থাকলেও করা যায়নি, তবে ‘হেমন্ত স্মৃতি স্মারক সম্মান’, ‘হেমন্ত স্মৃতি সঙ্গীত প্রতিযোগিতা’, হেমন্ত বক্তৃতামালা ও সংগ্রহশালা-সহ গুচ্ছ পরিকল্পনা বলবৎ। স্মরণ কমিটির ইউটিউব চ্যানেলে হেমন্ত-তর্পণ ‘আমাদেরই হেমন্ত’ শেষ হল ১৬ সেপ্টেম্বর— কলকাতা, বহির্বঙ্গ ও প্রবাসের গায়ক, শিল্পী, সুরকার, শিক্ষাবিদ, প্রবীণ-নবীনের অংশগ্রহণে। ছবিতে ১৯৭২-এর লন্ডনে বিবিসির অনুষ্ঠানে বেলা মুখোপাধ্যায় ও সহশিল্পী-সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ছবি সৌজন্য: হিমাদ্রি লাহিড়ী
পর্দায় গাঁধী
২০১৮-র গাঁধী জয়ন্তীতে শুরু হয়েছিল ‘মহাত্মা গাঁধী জন্মসার্ধশতবর্ষ উদ্যাপন’ অনুষ্ঠান, এ বছর ২ অক্টোবর তার সমাপ্তিতে ‘ফিল্মস ডিভিশন’-এর নিবেদন সপ্তাহব্যাপী ‘গাঁধী ফিল্মোৎসব’। শুরু হয়েছে ২৬ সেপ্টেম্বর, বৈষ্ণব জন তো অ্যানিমেশন ছবি দিয়ে। আছে ডন অব গাঁধীয়ান ইরা, দেন কেম গাঁধী, দ্য গ্রেট সল্ট মার্চ, দ্য হানড্রেড মিনিটস-এর মতো তথ্যচিত্র, বিশেষ আকর্ষণ চিলড্রেন’স ফিল্ম সোসাইটি প্রযোজিত বাপু নে কহা থা ও অভি কাল হি কি বাত হ্যায় ছবিদু’টি। ২ অক্টোবর পর্যন্ত সব ছবিই দেখা যাবে ফিল্মস ডিভিশন-এর ওয়েবসাইট ও ইউটিউব চ্যানেলে।
ভ্রম ও ভ্রমণ
কখনও সময় আসে, জীবন মুচকি হাসে। বিশ্ব পর্যটন দিবস গেল গত কাল, জীবনবাবাজি হাসলেন হোহো। বিদেশে লোকে সি-বিচ কাঁপাচ্ছে, কলকাতাও পারলে এক ছুট্টে দিঘা, কিন্তু রোগ বড় বালাই। সিঁথি টু গড়িয়া ছোটপিসির বাড়িই যাওয়া যাচ্ছে না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy