এই গ্রুপটি ইউফ্রেটিস ও আল-জ়াজ়িরার ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে নিবেদিত,” সমাজমাধ্যমে দায়রুজ়-জ়র শহরভিত্তিক একটি গোষ্ঠীর এই সাধারণ পরিচয়লিপি থেকে বোঝা মুশকিল— সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সেখানকার পারিবারিক ইতিহাস, শিল্প পরম্পরা-সহ সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখায় এ ধরনের নাগরিক গোষ্ঠীর কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই মুহূর্তে রাশিয়ার আগ্রাসনের মুখে ইউক্রেনেও নাগরিকদের একাধিক গোষ্ঠী যুদ্ধদীর্ণ খারকিভ বা লাভিভের মতো শহরের ঐতিহ্য সংরক্ষণের কাজ করছে। ‘অস্থাবর’ ঐতিহ্যের সঙ্গে মানুষ ও জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন যুক্ত থাকায় তার সংরক্ষণ আরও বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়ে, বিশেষত যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে ও সমাজমাধ্যমে এ ধরনের স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের গুরুত্ব অনুভূত হয় আরও বেশি করে।
বিপর্যয়জনিত পরিস্থিতি না হলেও, জনমানসে সচেতনতার অভাব ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা বা গাফিলতির জন্য ভারতের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনের অস্তিত্ব নিয়ে সব সময়েই একটা আশঙ্কা থাকে। কলকাতার চিত্রটাও খুব আলাদা নয়। শহরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে শুভবোধসম্পন্ন নাগরিকদের সঙ্ঘবদ্ধ চেষ্টার গুরুত্ব তাই আরও বেশি। কলকাতার দুর্গাপুজোর সাম্প্রতিক ইউনেস্কো-স্বীকৃতি নতুন করে ঐতিহ্য বাঁচানোর লড়াইকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে।
‘পুরনো কলকাতার গল্প সোসাইটি’ ফেসবুক গ্রুপটি বেশ কয়েক বছর ধরে কলকাতার ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। আন্তর্জালে তো বটেই, তার বাইরেও তাদের সভা, আলোচনা ও কর্মসূচি কম নয়। তারই অংশ হিসেবে এ বার পুজোয় তারা প্রকাশ করেছে পত্রিকা, ‘ঐতিহ্যের আবহে কলকাতার দুর্গাপুজো’ শিরোনামে বিশেষ শারদীয়া সংখ্যা। কলকাতার দুর্গাপুজোকে দু’মলাটে ধরার সনিষ্ঠ চেষ্টা— ঐতিহাসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। রয়েছে শহরের বনেদি বাড়িগুলির পুজো সম্পর্কে বহু তথ্য, পাশাপাশি এই বিশাল কর্মযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত কারিগর ও শিল্পীদের কথা। পুজো ও উৎসব ঘিরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও কলকাতার ঐতিহ্য, আছে তারও উদাহরণ। সুখপাঠ্য লেখাগুলি কলকাতার দুর্গাপুজোর বনেদি বাড়ির ঠাকুরদালান থেকে বারোয়ারি-সর্বজনীনের মণ্ডপ হয়ে আজকের বাণিজ্যিক পৃষ্ঠপোষকতা-সমৃদ্ধ, শিল্পবিশ্বের অন্যতম বৃহৎ স্ট্রিট আর্ট ফেস্টিভ্যাল পর্যন্ত ধারাবাহিক যাত্রাপথের একটা ধারণা তৈরি করে দেয়। দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে মহানগরের সুবিপুল অর্থনৈতিক লেনদেনের চালচিত্রের ছবিও পাওয়া যাবে এ থেকে। ছবিতে শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্যের আশির দশকে আঁকা দুর্গা চিত্রমালায় পুজোর শহর, পত্রিকা থেকে নেওয়া।
যুগাবসান
রজনীকান্ত সেনের দৌহিত্র তিনি, দিলীপকুমার রায় (ছবিতে)। জন্ম ১৯১৭ সালে, মামা সুকৃতি সেনের কম্পোজ়িশনে প্রথম রেকর্ড, আকাশবাণী-র ডাক। দ্বিজেন্দ্রলাল-পুত্র দিলীপকুমার রায়ের গায়কি জীবিত ছিল তাঁর কণ্ঠে। নামী গান সংস্থার প্রশিক্ষকের দায়িত্বের পাশাপাশি রজনীকান্তের গানের সংগ্রাহক হিসাবে যুগান্তকারী কাজ তাঁর, রজনীকান্ত-গীতির দু’টি স্বরলিপিগ্রন্থ তাঁর তত্ত্বাবধানেই প্রকাশিত। ছিলেন স্বতন্ত্র সঙ্গীতকারও, তাঁর কথায়-সুরে পান্নালাল ভট্টাচার্যের গাওয়া ‘আমি মন্ত্রতন্ত্র কিছুই জানি নে মা,’ ‘আমি সব ছেড়ে মা ধরব তোমার’— ইতিহাস। গানজগতের ‘মাস্টারমশাই’, তাঁর পরিচালনায় রেকর্ড করেছেন ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় সন্তোষ সেনগুপ্ত অর্ঘ্য সেন, এমনকি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর পঙ্কজকুমার মল্লিকও। জীবনে সেরা প্রাপ্তি কী? বলতেন— রবীন্দ্রনাথের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে পারা, নজরুলের কাছে তালিম, দিলীপকুমার রায় ও হিমাংশু দত্তের সান্নিধ্য। গত ২৩ সেপ্টেম্বর ১০৫ বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসানের সঙ্গে মুছে গেল বাংলা কাব্যগীতির এক আলোকযুগের শেষ চিহ্নও।
লেখা রবে
২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯, আনন্দবাজার পত্রিকা-র প্রথম পৃষ্ঠার খবর: হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নেই। আগের রাতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, রাত ১১টা ১৫ মিনিটে সব শেষ। সে বছর ষষ্ঠী ছিল ৬ অক্টোবর, পুজোর আগেই বাঙালির সঙ্গীতভুবনে নেমে এসেছিল বিসর্জনের বিষাদ। জন্মদিন পালনেই বাংলা সপ্রাণ, প্রিয় শিল্পীর প্রয়াণের স্মৃতি পুষতে চায় না মনে। ১৬ জুন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন উদ্যাপনেই সোৎসাহী শতাব্দী ব্যালে ট্রুপ, ২০০৬ সাল থেকে নিয়মিত পালন করে আসছে সঙ্গীত ও স্মৃতির অর্ঘ্যে। এ বছর তাদের অনুষ্ঠান হয়ে গেল শিল্পীর প্রয়াণদিনে, ২৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায়, রবীন্দ্র সদনে: ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’। বিশিষ্ট শিল্পীদের গান ও শিল্পী-স্মরণ, ছিল গানের কোলাজ-নৃত্যরূপ। সার্বিক পরিকল্পনা ও পরিচালনা দেবাশিস বসুর।
আগমন্ডা
নৈবেদ্যর আগায় ঠাঁই, নারকেলের এই মিষ্টির নাম তাই ‘আগমন্ডা’। কুমোরটুলির অভয়চরণ মিত্রের বাড়িতে গরুর গাড়ির চাকার মতো জিলিপি বা কামানের গোলা মাপের মোতিচুর লাড্ডুর নৈবেদ্য হত, নীচ থেকে উপরে সাজানো হত বহু মিঠাই। তারই চুড়োয় ঠাঁই আগমন্ডার। অষ্টমীর নৈবেদ্যশীর্ষের আগমন্ডা ওজনে হত দশ-বারো সের, ১২৭১ বঙ্গাব্দে মিত্রবাড়ির পুজো দেখে লিখেছিলেন অমৃতলাল বসু, আত্মস্মৃতিতে। বনেদি পুজোয় তার নানা রূপটান, গায়ে চন্দনী ক্ষীরের প্রলেপ, চূড়ায় পেস্তা-কিসমিসের সাজ। শোভাবাজার দেব বাড়ির আগমন্ডা তৈরি হয় বেশ আঁট করে, ছানা-চিনির পাকে। বাড়ির সদস্য অলোক কৃষ্ণ দেব জানালেন, ষষ্ঠীর বোধনের নৈবেদ্যে অপরিহার্য সে।
ত্বং হি
এক সন্ধে, চারটি ছবি। দ্য ডে আই বিকেম আ উওম্যান ছবিতে পরিচালক খুঁজে যান প্রথম ঋতুমতী হওয়ার অভিজ্ঞতা ঘিরে বহু প্রশ্নের উত্তর। চেজ়িং টেলস ছবিতে মুম্বইয়ের বস্তির বাসিন্দা মুনিরা এক নিশীথিনী, গভীর রাতে বেরিয়ে পড়েন হাইওয়ে ফুটপাত উড়ালপুল-তলার কুকুর-বেড়ালদের খাওয়াতে। অ্যাসিড-আক্রমণের শিকার মেয়েদের জীবনসংগ্রাম স্টপ অ্যাসিড অ্যাটাক ছবিতে, ড্রামা কুইনস ছবিতে বি জয়শ্রী মলয়শ্রী হাশমি আর সাবিত্রী হেইসনামের স্বতন্ত্র নাট্য-আঙ্গিকের সূত্রে উদ্ভাসিত ভারতীয় থিয়েটারে নারীদের স্বতন্ত্র কৃতি। ছবিগুলি েদখানো হল ফিল্মস ডিভিশন ও বিড়লা অ্যাকাডেমির উদ্যোগে গত ২৩ সেপ্টেম্বর; মৌপিয়া মুখোপাধ্যায় মাধবী ট্যাঞ্জেলা ফারহা খাতুন সোহিনী দাশগুপ্ত, চার পরিচালক ও অন্য চার পরিসরের বিজয়িনী সংবর্ধিত হলেন ‘ত্বং হি দুর্গা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে।
আন্তরিক
‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ বা ‘আমায় ক্ষম হে ক্ষম’... গান-স্মৃতির সঙ্গে অচ্ছেদ্য তিনি, সুচিত্রা মিত্র। নটীর পূজা-য় শ্রীমতীর গানেও অনন্যা। গত ১৯ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিনে পূর্বশ্রী প্রেক্ষাগৃহে হয়ে গেল ‘সুচিত্রা মিত্র উৎসব ২০২২’— শিল্পীর অন্যতম শিষ্যা ও ‘পূরবী মিউজ়িক সার্কল’-এর কর্ণধার মন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে, পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্রের সহযোগিতায়। নিবেদিত হল নটীর পূজা অবলম্বনে ‘শেষ আরতির শিখা’ ও ‘পণমামি বুদ্ধং’। পূরবী-র সদস্যদের রবীন্দ্রগান, নানা সংস্থার নিবেদনে সম্মেলক গান, নৃত্যে শান্তিনিকেতন গোষ্ঠী। দু’বছর পরেই শিল্পীর জন্মশতবর্ষ, তার আন্তরিক নান্দীমুখ যেন এই উদ্যাপন।
গানের পুজো
৭ নম্বর এসপ্লানেড রোড, গ্রামোফোন কোম্পানির ঠিকানা, ১৯০১-এ। পরের বছর শশীমুখীর গাওয়া গান ‘আমি কি সজনী কুসুমেরি’ রেকর্ড হল, শব্দ গ্রহণই সার, মুদ্রিত হত বিদেশে। ১৯০৭-এ কোম্পানি ঠিকানা বদলে ১৩৯ বেলেঘাটা রোডে, এশিয়া তথা ভারতে প্রথম ধ্বনি মুদ্রণের কাজ শুরু েসখানেই। নবযুগসূচনা... রেকর্ড প্রকাশের ধুম, ধুম হৃৎকমলেও। দুর্গাপুজো উপলক্ষে বাংলা গান, আগমনী, বিজয়া গীতির রেকর্ড বেরোত। ১৯১৪-র পুজোয় বাংলা গ্রামোফোন রেকর্ডের তালিকা-পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। সতেরোটি গান, শিল্পীরা: মানদাসুন্দরী দাসী কে মল্লিক নারায়ণ মুখোপাধ্যায় বেদানা দাসী (ছবিতে ডান দিকে) অমলা দাশ প্রমুখ। ক্রমে পায়োনিয়ার মেগাফোন হিন্দুস্থান ভারত সেনোলা ইত্যাদি রেকর্ড কোম্পানিও পুজোর গানের পুস্তিকা প্রকাশ শুরু করে: শারদ অর্ঘ্য, শারদীয়া অর্ঘ্য (ছবিতে বাঁ দিকে), শরৎ বন্দনা, নানা নামে। ১৯১৪-১৯৪০ পর্যন্ত পুজোর গানের তথ্য, রেকর্ড লেবেল, পুস্তিকা প্রচ্ছদ, নামপত্রের লেবেল, শিল্পীদের ছবি-সহ অনেক কিছু নিয়ে ২৫-২৭ সেপ্টেম্বর এক চিত্রপ্রদর্শনী হল উত্তরপাড়া জীবনস্মৃতি আর্কাইভে, অরিন্দম সাহা সরদারের ভাবনা ও রূপায়ণে। জরুরি কাজ।
নব নব রূপে
বনহুগলির ৭৭/৫ রাইমোহন ব্যানার্জি রোডের পুরনো ফ্ল্যাটবাড়িতে না ঢুকলে বিশ্বাস হবে না, ভিতরে কোন ‘শিল্প বিপ্লব’ সাধিত হচ্ছে। গৃহকর্তা হরিসাধন বিশ্বাস নিয়ম করে পুজোর আগে একটি ঠাকুর গড়েন, ছোট্ট। তার মূল উপকরণ ভাববার, আর অবাক করার মতো। তেজপাতা, ফুলের পাপড়ি, বীজ, ট্যাবলেট, চামড়ার টুকরো, গেঞ্জি-কাপড়, তার, ময়দা, রবারের পাইপ, কী না তাঁর হাতে রূপ পেয়েছে দশভুজায়! নীচের ছবিটিই যেমন, েদখলে বোঝার জো নেই মহিষমর্দিনী সিংহবাহিনী তৈরি— রসুনের খোসা দিয়ে (ছবিতে)! সেই দিয়েই দেবীর মুকুট, প্রহরণ, সিংহের কেশর। এর আগে এক বার পেঁয়াজের খোসা দিয়েও বানিয়েছিলেন। আট ইঞ্চি উচ্চতার, সাকুল্যে ৫০ গ্রাম ওজনের এই শিল্পকর্ম সাধনারই ফল।
প্রয়াণ
যাত্রা, থিয়েটার, আধুনিক কবিতা ও নাট্য-পত্রিকার লেখক, সম্পাদক, জীবনানন্দ গবেষক, বহুপরিচয়ে খ্যাত ছিলেন প্রভাতকুমার দাস (১৯৪৫-২০২২)। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা বিভাগে কাজ করেছেন দীর্ঘ কাল, অবসর ২০০৪-এ। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পত্রিকা ও প্রকাশন অধ্যক্ষ, পরে সহ-সভাপতি; ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি ও তার পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীরও সদস্য। সম্পাদনা করেছেন পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমি পত্রিকা। বহুরূপী পত্রিকার সহযোগী ও পরে নির্বাহী সম্পাদক; লিখেছেন যাত্রার সঙ্গে বেড়ে ওঠা, যাত্রা-থিয়েটার ও অভিযাত্রা-র মতো বই, বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস-সহ সম্পাদিত গ্রন্থও বহু। বলেছেন নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে, সাহিত্য অকাদেমির আমন্ত্রণে, পড়িয়েছেন রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে; ভূষিত বহু সম্মাননায়। কত কাজ বাকি ছিল আরও, গত ১৮ সেপ্টেম্বর চলে গেলেন হঠাৎই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy