রবীন্দ্র সরোবর লেকে চুপচাপ বসে যুগলদের দেখে যায় যুবকটি। সংলাপ না শুনেও, শুধু অঙ্গভঙ্গি থেকেই বোঝা যায় কারা প্রণয়ী, বিবাহিত জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে এসেছে কারা। বিনা সংলাপে গল্প মঞ্চায়নের চিন্তা সে থেকেই মাথায় আসে কমেডিয়ান হিসেবে পঞ্চাশের দশকে পায়ের তলায় মাটি খুঁজতে থাকা যোগেশ দত্তের।
দেশছাড়া আরও বহু মানুষের মতো এক দিন এই শহরে এসেছিল তাঁর পরিবার। কঠোর জীবনসংগ্রাম। দশ দিনের ব্যবধানে হারান মা-বাবা দু’জনকেই। চা-দোকান, মুদি দোকান, কন্ট্রাক্টরের কাছে কাজের পাশাপাশি চলেছে শিল্পে নিজস্ব পরিচিতির খোঁজ। সেই সূত্রেই নবরূপ পেল এক শিল্প আঙ্গিক— মূকাভিনয়। কয়েক দশক ধরে মঞ্চে মানুষের জীবন থেকে তুলে আনা সুখদুঃখের শব্দহীন উপস্থাপনায় শুধু দেশ-বিদেশের প্রশংসাই পাননি, এক স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন ভারতীয় মূকাভিনয়কে। উৎসাহ দিয়েছেন সত্যজিৎ রায়, শম্ভু মিত্র; সঙ্গে পেয়েছেন খালেদ চৌধুরী, তাপস সেন, ভি বালসারাকে। তাঁর নিজের কথায়, ‘গ্রামার, জিয়োমেট্রি না থাকা’ এই শিল্পের সুষ্ঠু চর্চার জন্যই তৈরি করেছেন অ্যাকাডেমি, নির্মাণকালে মাথায় করে মশলাও বয়েছেন নিজে। সেই যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমিতে কর্মশালায় এসে তাঁর কাজে নিহিত ভারতীয়ত্বকে কুর্নিশ করে গেছেন বিশ্বখ্যাত মূকাভিনয় শিল্পী মার্শাল মার্সো, এক দিন এ শহরে যাঁর শো অর্থাভাবে দেখতে পারেননি তিনি। মূকাভিনয়কে তাঁর বহু ছাত্রের জীবিকা নির্বাহের সিঁড়ি হিসেবে গড়ে দিতে সতত প্রয়াসী নবতিপর এই শিক্ষক।
মঞ্চকে বিদায় জানিয়েছেন ২০০৯-এ। তাঁর সমস্ত উদ্যোগ যাকে ঘিরে, সেই যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমির শেকড়-সংস্থা ‘পদাবলী’র সুবর্ণজয়ন্তী এ বছর। সেই উপলক্ষে ৮-১০ ডিসেম্বর যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমিতে ৪২তম মূকাভিনয় উৎসবের আহ্বায়ক তিনিই, কন্যা প্রকৃতি দত্তকে সঙ্গে নিয়ে। মূল আকর্ষণ যোগেশ দত্তকে নিয়ে অশোককুমার চট্টোপাধ্যায়ের তথ্যচিত্র নৈঃশব্দ্যের কবিতা। তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্র হয়েছে আগেও, ফিল্মস ডিভিশন-এর প্রযোজনায় সুরজিৎ দাশগুপ্তের আ সাইলেন্ট আর্ট (১৯৮৩)। এ বার এক ঘণ্টার ছবিতে নৈঃশব্দ্যের শিল্পীর শিল্পভাষ, ৯ ডিসেম্বর সন্ধে ৬টায়। থাকছে মূকাভিনয়ের কর্মশালা। প্রতি দিন মূকাভিনয়— যোগেশ দত্তের বিখ্যাত কাজগুলির পুনর্নির্মাণে শ্রীকান্ত বসু, অরিন্দম বর্মণ; সঙ্গীত নাটক অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী মইনুল হক-সহ অন্য শিল্পীদের পরিবেশনাও। ১০ তারিখ সন্ধে ৭টায় গৌতম হালদার অভিনীত আমাকে দেখুন। উদ্বোধন-সন্ধ্যায় উৎসব-আচার্য শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে ‘পদাবলী সম্মান’-এ ভূষিত হবেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব অরুণ মুখোপাধ্যায়। ছবিতে ২০০৭-এ চার্লি চ্যাপলিন পরিবার মূকাভিনয়-নাট্যের আগে মেক-আপ রুমে যোগেশ দত্ত ও সহশিল্পীরা।
নির্মল করো
হিন্দি অনুবাদে রবীন্দ্রসঙ্গীত পছন্দ ছিল না হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের (ছবিতে)। রবীন্দ্রগানের পাশাপাশি প্রবল অনুরাগ ছিল কান্তগীতি আর অতুলপ্রসাদিতে, যদিও রেকর্ডে গেয়েছেন অল্পই। ছায়াছবিতে যেমন স্মরণীয় হয়ে আছে মান্না দে’র গলায় ‘তব চরণনিম্নে’ (সুভাষচন্দ্র) কিংবা অরুন্ধতী দেবীর ‘কেন বঞ্চিত হব’ (হারমোনিয়াম), তেমনই হেমন্ত নিজে না গাইলেও হৈমন্তী শুক্লকে দিয়ে গাইয়েছিলেন ‘তুমি নির্মল করো’, মোহনবাগানের মেয়ে ছবিতে (১৯৭৬)। এ বার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে রজনীকান্ত সেনের সেই গানের একটি লাইভ রেকর্ডিং সম্প্রতি ইউটিউবে এল, সৌজন্যে মল্লার মজুমদার ও শ্রীনিবাস মিউজ়িক। এ গান সত্তর দশকে কোনও অনুষ্ঠানে গাওয়া। রেকর্ডিং খুব জুতসই নয়, তাই ডিজিটাল পদ্ধতির আশ্রয়। তাতে অবশ্য গানের প্রতি শিল্পীর সম্মান ও অনুরাগ ঢাকা পড়েনি।
সুচর্চা
প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প, কবিতা, অনুবাদ কবিতা, অনুবাদ গল্প, বিজ্ঞান, গ্রন্থ আলোচনা, গানের গল্প, স্মৃতিচারণমূলক গদ্য, সাক্ষাৎকারভিত্তিক রচনা। সাহিত্যের প্রায় সব ক’টি ক্ষেত্রকেই ন’শো ছুঁই-ছুঁই পৃষ্ঠার বিশাল পরিসরে তুলে এনেছে পরম্পরা পত্রিকার (সম্পাদনা: গৌতম দাশ) উৎসব ১৪২৮ সংখ্যা। বিশেষ আকর্ষণ প্রমথ চৌধুরী, অমিয়নাথ সান্যাল, শিশিরকুমার দাশের অগ্রন্থিত রচনা, হেমন্তকুমার সরকারের অপ্রকাশিত রচনা ‘কবিপ্রণাম’, সৌরীন ভট্টাচার্যের আত্মকথা। প্রয়াত প্রাবন্ধিক প্রদীপ বসুর দীর্ঘ প্রবন্ধের পাশে চিন্ময় গুহ-প্রভাতকুমার দাস-ভবেশ দাশ’সহ বিশিষ্টজনের রচনা, ‘বিজ্ঞানচর্চা’-য় আশীষ লাহিড়ীর নিবন্ধ, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার-ভিত্তিক রচনা ‘থিয়েটারের খোলা হাওয়ায়’।
নব রূপে
ভিতরের মানুষটা মনের ভিতর খুঁড়ে দেখতে চেয়েছিল, মন বস্তুটি কী! সেই চাওয়া থেকেই ফিয়োদর দস্তয়েভস্কির দ্য জেন্টল স্পিরিট-কে মরমিয়া মন-এ রূপান্তর করেছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। “এক সর্বস্বান্ত পুরুষের জবানিতে নাটকটি নারী-পুরুষ সম্পর্কের চিরকালীন রহস্য, দ্বন্দ্ব, টেনশন ও নিরুপায়তাকে আবিষ্কার করতে করতে চলে...” নাট্যকৃতি প্রসঙ্গে লিখেছিলেন জয় গোস্বামী। নাটক নির্মাণের প্রথম পর্ব শুরু হয় নান্দীকারে, আলোক পরিকল্পনায় ছিলেন তাপস সেন। কুড়ি বছর পর নতুন রূপে গৌতম হালদার ও ‘নয়ে নাটুয়া’ নাট্যদলের উদ্যোগে মঞ্চস্থ হতে চলেছে মরমিয়া মন, গৌতমেরই অভিনয় ও নির্দেশনায়। এ নাটকের সঙ্গীত করেছিলেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, তাঁর স্মরণে ও শ্রদ্ধায় নিবেদিত প্রথম অভিনয়টি ‘নয়ে নাটুয়া’-র জন্মদিনে, ৯ ডিসেম্বর, সন্ধে সাড়ে ৬টায় অ্যাকাডেমি মঞ্চে।
অঘ্রানের কবিতা
দে’জ পাবলিশিং-এর বইঘরে ৬-৯ ডিসেম্বর হতে চলেছে কবিতা উৎসব, ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’। উপলক্ষ প্রকাশনার সুবর্ণজয়ন্তী (১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠা)। শুরুর দিনটিতেই বাবরি-ধ্বংসের তারিখ ত্রিশ বছরে পা দিচ্ছে। একদা কবিতা উৎসব ‘ধ্বংসস্তূপে আলো’ সংগঠিত করেছিলেন শঙ্খ ঘোষ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, এই আয়োজন সেই প্রতিবাদী ঐতিহ্যেরই সেতুবন্ধ। ইনদওর থেকে কবিতা পড়তে আসছেন উর্দু কবি হুসেন হায়দ্রি। কবিতার গানে ‘দোহার’। প্রকাশ পাচ্ছে অমিতাভ গুপ্ত, মৃদুল দাশগুপ্ত, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা। জীবনানন্দ দাশের ধূসর পাণ্ডুলিপির রাজ সংস্করণের ফ্যাকসিমিলি উন্মোচনে জয় গোস্বামী। কবিতা নিয়ে বলবেন তিনি, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধ সরকার প্রমুখ। অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আলোচনায় তরুণ মজুমদার, চিন্ময় গুহ, অভীক মজুমদার-সহ বিশিষ্টজন।
অনুপুঙ্খ
সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে ব্যঞ্জনা কী ভাবে শুধু রেনোয়া-র নয়, কালিদাস মহাভারত বঙ্কিমচন্দ্র বা জয়পুর মিনিয়েচার চিত্রকলা থেকেও উঠে এসেছে, কী ভাবে তিনি রবীন্দ্রনাথ কথিত ‘রূপের চলৎপ্রবাহ’ সৃষ্টি করেছেন, কেমন তাঁর ছবির সাঙ্গীতিক বিন্যাস, এ নিয়ে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ উঠে এল চিন্ময় গুহের কথনে, সাহিত্য অকাদেমি আয়োজিত দু’দিনব্যাপী (২৫-২৬ নভেম্বর) আলোচনাচক্রে। অকাদেমি সচিব কে শ্রীনিবাসরাও, আহ্বায়ক সুবোধ সরকারের ভাষণ ছাড়াও সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, এস ভি রমণ, অশোক বিশ্বনাথনের সভাপতিত্বে বিশিষ্ট বক্তাদের আলোচনা... সত্যজিতের আধুনিকতা ও রাজনৈতিক মানস, চিত্রকর ও অনুবাদক সত্যজিৎ, তাঁর ছবিতে বন্ধুত্ব ও বিবেকের স্বরূপ, চিত্রনাট্য ও কত্থক নৃত্যের বিবর্তন, শৈলীর গাণিতিক গড়ন-সহ নানা বিষয়ে। দেখানো হল শ্যাম বেনেগালের তথ্যচিত্র সত্যজিৎ রায়। উদ্বোধনী ও সমাপ্তি ভাষণে যথাক্রমে গৌতম ঘোষ ও অপর্ণা সেন।
মৃৎভাষ্য
শিল্পমাধ্যম হিসাবে সেরামিক্স অনন্য, কারণ এখানে শিল্প নির্মাণের প্রধান উপাদান মাটি। মাটির নমনীয়তাও সেরামিক্স শিল্প নির্মাণের অন্যতম সেতু, কারণ মাটির গায়ে থেকে যায় প্রতিটি স্পর্শের চিহ্ন। সেই গড়ে ওঠা আকৃতি আগুনে পুড়ে শিল্পে উত্তীর্ণ হয়। তাপসহন ক্ষমতার উপর নির্ভর করে মাটির আদল, আকৃতি, কাঠিন্য। তৈজসপত্র, স্থাপত্যবস্তুর পাশাপাশি সেরামিক্স মাধ্যমে স্বাধীন শিল্পচর্চার নিদর্শন ভারতে অনেক। নমনীয় মৃত্তিকার সেরামিক্স শিল্প হয়ে ওঠার সেই মৃৎভাষ্য নিয়েই প্রদর্শনী ‘ভূ’, চলছে কলকাতার ইমামি আর্ট-এ। রয়েছে ফাল্গুনী ভাট, দেবেশ উপাধ্যায় (নীচে ছবিতে তাঁর একটি কাজ), সরস্বতী, কেশরী নন্দন প্রসাদ, ইন্দ্রাণী সিংহ কাসিমি, শালিনী দাম, কবিতা পাণ্ড্য গঙ্গোপাধ্যায়, পার্থ দাশগুপ্ত-সহ বারো জন সেরামিক্স শিল্পীর শিল্পকর্ম। প্রদর্শনী ১২ ডিসেম্বর অবধি, সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা।
দেড়শোর যাত্রা
উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিট অঞ্চলে স্কটল্যান্ডের মহিলা মিশনারিরা কয়েকজন অনাথ মেয়েকে নিয়ে যে স্কুল শুরু করেছিলেন, সেটিই পরে, ১৮৭১-এর ১৬ নভেম্বর ১৯ নম্বর ডাফ স্ট্রিটের ঠিকানায় চলে আসে সেন্ট মার্গারেট’স স্কুল নামে। এ বছর সেই স্কুলের দেড়শো বছর। এ দেশে নারীশিক্ষায় স্কটিশ মিশনারিদের ভূমিকা অনস্বীকার্য, তাঁদেরই অন্যতম রেভারেন্ড আলেকজান্ডার ডাফ-এর সেন্ট মার্গারেট’স স্কুল স্থাপনে অবদানও অসামান্য। স্কটল্যান্ডের মহীয়সী নারী মার্গারেটের (উপরে ছবিতে) নামে এই স্কুলের মূলমন্ত্র: ‘বাই লাভ সার্ভ ওয়ান অ্যানাদার।’ প্রথম বাঙালি অধ্যক্ষা লাবণ্যপ্রভা মল্লিক (১৯৫০-৬৮) স্কুলকে পৌঁছে দিয়েছিলেন উৎকর্ষে। অমলাশঙ্কর, দূর্বা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকুমারী ভট্টাচার্য, গৌরী ধর্মপাল খ্যাতনামা প্রাক্তনী। শতাব্দীপ্রাচীন স্কুলটি এই সে দিনও ছিল জমজমাট, আজ নানা কারণে সে জৌলুস কমেছে। স্কুলের দেড়শো বছরের বর্ষব্যাপী উদ্যাপন শুরু হয়েছে ২৯ নভেম্বর, কোভিডবিধির কারণে প্রাক্তনীরা আয়োজন করেছেন আন্তর্জাল উদ্যাপন। স্কুলের স্বর্ণালি ঐতিহ্যকে ছবিতে ধরে রাখতে একটি তথ্যচিত্র করছেন স্কুলেরই প্রাক্তনী, চিত্রপরিচালক শতরূপা সান্যাল।
সময়ের গল্প
‘টাইপরাইটার’ গ্রহে সংখ্যালঘু ভাওয়েলদের ওপর সংখ্যাগুরু কনসোনেন্টরা জুলুম করছে: ওদের বার করে দে! গল্পটা চেনা? অক্সফোর্ড বুক স্টোরে রয় ফিনিক্সের প্রথম উপন্যাস অ্যালফাবেটিকা-র (নোশন প্রেস) উদ্বোধনে সহমত অপর্ণা সেনও, এ আমাদের সময়েরই গল্প। কুণাল বসুর মত: ইউরোপ-আমেরিকা সর্বত্রই এই। সুমন্ত চট্টোপাধ্যায় বোঝালেন, ইংরেজি বর্ণমালার ইতিহাসে কী ভাবে ফুটে ওঠে জাতপাতের রাজনীতি। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে এক বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে রয় শুনেছিলেন, এক-একটা অক্ষরকে সবাই বলছে ‘ক্যারেক্টার’। সেখানেই এই উপন্যাসের শেকড়। কলকাতা বইয়ের শহর, তাই এখানেই হল উদ্বোধন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy