নতুন গাড়ি কেনা, নতুন দমকল কেন্দ্র উদ্বোধনের বিরাম নেই। কিন্তু নতুন গাড়ি কেনা হলেও সেগুলি চালাবে কে? লোকই তো নেই। এমনই অবস্থা দমকল দফতরের।
দফতর সূত্রের খবর, রাজ্যে এত দিন ১০২টি দমকল কেন্দ্র ছিল। গত পাঁচ বছরে উদ্বোধন হয়েছে ২৮টি দমকল কেন্দ্রের। সব মিলিয়ে ১৩০টি কেন্দ্রে নতুন ও পুরনো মিলে রয়েছে ৬০০টি ইঞ্জিন। শুধু গত দু’বছরেই কেনা হয়েছে ২২২টি গাড়ি। ফের গাড়ি কেনার জন্য বরাদ্দ হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। এত ঢক্কানিনাদের পরেও অবশ্য ছবিটা পাল্টায়নি। পুরনো ১০২টি দমকল কেন্দ্র এমনিতেই ধুঁকছে লোকাভাবে। তার উপরে নিত্য নতুন দমকল কেন্দ্র চালু করার ফলে অবস্থা হয়ে উঠেছে শোচনীয়। নয়া কেন্দ্রগুলিতে নতুন নিয়োগ না হওয়ায় পুরনো কেন্দ্রগুলি থেকেই কর্মীদের এনে কাজ চালাতে হচ্ছে।
বর্তমানে দমকল দফতরে অফিসার থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত খালি রয়েছে তিন হাজারেরও বেশি পদ। এর মধ্যে চালকের শূন্যপদের সংখ্যা ৪০০-রও বেশি। পাশাপাশি, রাজ্যের বিভিন্ন দমকল কেন্দ্রে ‘সাব-অফিসার’ ও ‘স্টেশন অফিসার’ নেই প্রায় ২৫০ জন।
এক দমকল কর্তার কথায়, ‘‘প্রতি মাসেই কোনও না কোনও চালক অবসর নেওয়ায় সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। বিভিন্ন স্টেশনে পর্যাপ্ত ড্রাইভার না থাকায় বড় আগুন লাগলে অফিসারেরাই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যান।’’
যেমন গার্ডেনরিচের আরিফনগর দমকল কেন্দ্র। চালক থাকার কথা ১২ জন। আছেন মাত্র ৪ জন। ওই কেন্দ্রে তিনটি ইঞ্জিন রয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত চালক না থাকায় বাধ্য হয়ে অন্য স্টেশনের দ্বারস্থ হতে হয়। ‘‘আরিফনগর একটি উদাহরণ মাত্র। রাজ্যের প্রায় সব ফায়ার স্টেশনে পর্যাপ্ত চালক না থাকায় ভীষণ সমস্যা হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওভারটাইম দিয়ে কাজ সারতে হচ্ছে। কিন্তু এই ব্যবস্থা তো বেশি দিন চলতে পারে না’’— মন্তব্য এক দমকল কর্তার। চালকের পাশাপাশি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে দু’হাজারের বেশি ‘ফায়ার অপারেটর’-এর অনুপস্থিতি। তাঁরাই আগুন নেভানোর কাজ মূলত করে থাকেন। রাজ্যের ১৩০টি স্টেশনে ফায়ার অপারেটর থাকার কথা ৪৮০০। আছেন মাত্র ২৫০০ জন। ফায়ার অপারেটরদের যিনি লিড করবেন, সেই ‘লিডার’-এর শূন্যপদের সংখ্যা ২৫৫।
নিয়ম অনুযায়ী, আগুন নেভানোর জন্য দমকলের গাড়িতে চার জন ফায়ার অপারেটর, এক জন লিডার, এক জন সাব-অফিসার ও এক জন চালক থাকার কথা। কিন্তু কর্মীর অভাবে গাড়িতে সর্বসাকুল্যে থাকছেন ৪-৫ জন কর্মী। এক আধিকারিকের পর্যবেক্ষণ, ‘‘আগুন নেভানোর কাজে পর্যাপ্ত কর্মীর উপস্থিতি একটা বড় ফ্যাক্টর। ঘটনাস্থলে দ্রুততার সঙ্গে পৌঁছে যত বেশি লোক কাজ করবেন, তত দ্রুততার সঙ্গে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। কিন্তু পর্যাপ্ত কর্মী না থাকায় এ ভাবেই আমাদের কাজ চালাতে হচ্ছে।’’
আবার, আগুন নেভানোর জন্য সংশ্লিষ্ট দমকলকেন্দ্র থেকে বেরোনো গাড়িকে কন্ট্রোল রুম থেকে নজরদারি করেন ওই কেন্দ্রের মোবিলাইজিং অফিসার অথবা অ্যাসিস্ট্যান্ট মোবিলাইজিং অফিসার। কিন্তু বর্তমানে ওই দু’টি পদ মিলিয়ে মোট ৬৭টি পদ ফাঁকা থাকায় ঘটনাস্থলে যাওয়া গাড়িগুলির উপরে যথাযথ নজরদারি করা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন দমকলের কর্তারাই।
কর্মীর অভাবের কথা মেনে নিয়েছেন রাজ্যের দমকল মন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘ইতিমধ্যেই ২০০ অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে। তিন হাজার শূন্যপদ পূরণ করার ব্যাপারেও আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে।’’ বুধবার খিদিরপুরে একটি অস্থায়ী দমকল কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন শোভনবাবু। উপস্থিত ছিলেন পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। পরে দমকল মন্ত্রী বলেন, ‘‘ভবিষ্যতে বেহালা, রাজাবাজার, গার্ডেনরিচ ও ভাঙড়ে এই ধরনের অস্থায়ী দমকলকেন্দ্র চালু করা হবে।’’ পাশাপাশি, রাজারহাটে তিন একর জায়গায় সদর দফতরের মতো দমকল কেন্দ্র তৈরি করা হবে বলেও এ দিন ঘোষণা করেন দমকলমন্ত্রী।
এ দিকে, যথাযথ পরিকাঠামো ছাড়াই অস্থায়ী দমকলকেন্দ্রের উদ্বোধন করা নিয়ে সরব হয়েছেন দফতরের কর্মীদেরই একাংশ।
তাঁদের অভিযোগ, ‘‘কোনও ছাউনি ছাড়াই একটি জায়গায় শুধু দমকলের একটি গাড়ি রাখা হচ্ছে। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কর্তব্যরত কর্মীদের বসার জায়গা নেই।’’ এ প্রসঙ্গে দমকলমন্ত্রী শোভনবাবু অবশ্য বলেন, ‘‘যে সব জায়গায় অস্থায়ী কেন্দ্র চালু হয়েছে, সেখানে স্থায়ী কেন্দ্র চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। স্থায়ী কেন্দ্র হয়ে গেলে আর সমস্যা হবে না।’’