দহন-জ্বালা: মার্চের শেষেই শহরের তাপমাত্রার পারদ অনেকটাই চড়তে শুরু করেছে। যার জেরে ইতিমধ্যেই গলতে শুরু করেছে রাস্তার পিচ। সোমবার, ধর্মতলায়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
২০১৫ সালে অতিবৃষ্টির কারণে চেন্নাইয়ের বন্যায় যখন প্রায় ৩০০ মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল, যখন বহু জায়গায় জলস্তর কয়েক মিটার উঠে গিয়েছিল এবং অগুনতি মানুষ মারণ স্রোতের হাত থেকে বাঁচতে ছাদে বা অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় উঠে প্রাণরক্ষার লড়াই চালাচ্ছিলেন, তখনই ঘটনাচক্রে কলকাতার কয়েকটি ওয়ার্ডে একটি সমীক্ষা শুরু করেছিল কলকাতা পুরসভা এবং কলকাতার ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনের নেতৃত্বাধীন এক গবেষক-দল।
শহরের ৩৩, ৫৮, ৭৩, ১৪৩-সহ কয়েকটি ওয়ার্ডের ভৌগোলিক অবস্থান দেখে সমীক্ষক দল জানিয়েছিল, প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন বন্যা, ভূমিকম্প, তাপপ্রবাহ ও সাইক্লোনের ক্ষয়ক্ষতির নিরিখে কলকাতা রয়েছে ‘হাই রিস্ক জ়োনে’। ওই বছরেই বিশ্বব্যাঙ্কের আর একটি রিপোর্ট বন্যা-প্রবণতার নিরিখে বিশ্বের উপকূলবর্তী শহরগুলির মধ্যে কলকাতাকে তৃতীয় স্থানে রেখেছিল। সংশ্লিষ্ট রিপোর্টগুলির উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞদের একাংশ জানাচ্ছেন, এ সবই আসলে বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের হাত ধরে এই শহরের সঙ্গে গোটা বিশ্বই ক্রমশ বদলে যাচ্ছে।
যেমন কেন্দ্রীয় ভূবিজ্ঞান মন্ত্রকের কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, ১৯৭০-২০১৯, এই ৫০ বছরে বিশ্বে প্রায় ১১ হাজার প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে। মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, ‘‘যে বিপর্যয়ে প্রাণহানি হয়েছে সাড়ে ২০ লক্ষ মানুষের। অর্থক্ষতি হয়েছে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ২৭ লক্ষ ৪৬ হাজার কোটি টাকা!’’ ফলে এই করালগ্রাসের থেকে মুক্তি নেই কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গেরও, আশঙ্কা পরিবেশবিজ্ঞানীদের।
কেন্দ্রীয় আবহবিজ্ঞান দফতর সূত্রের খবর, দেশের উপকূলবর্তী ৯৬টি জেলাকে সাইক্লোনপ্রবণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অতি স্পর্শকাতর, স্পর্শকাতর, মাঝারিপ্রবণ এবং কমপ্রবণ জেলার সংখ্যা যথাক্রমে ১২, ৪১, ৩০ এবং ১৩। ১২টি অতি স্পর্শকাতর জেলার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার চারটি করে, অন্ধ্রপ্রদেশের তিনটি ও পুদুচেরির একটি জেলা রয়েছে। ‘‘রাজ্যের চারটি অতি স্পর্শকাতর জেলার মধ্যে মেদিনীপুর ছাড়াও রয়েছে কলকাতা এবং দুই ২৪ পরগনা।’’—বলছেন আবহবিজ্ঞান দফতরের এক কর্তা।
ফলে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়প্রবণ শহরগুলির মানচিত্রে যেন ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছে কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চল। কেন্দ্রীয় আবাসন ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের অধীনস্থ ‘বিল্ডিং মেটেরিয়ালস অ্যান্ড টেকনোলজি প্রোমোশন কাউন্সিল’-এর এক পদস্থ কর্তা বলছেন, ‘‘ভূমিকম্প প্রবণতার নিরিখে দুই ২৪ পরগনা ও কলকাতা যথাক্রমে ‘হাই’ এবং ‘মডারেট আর্থকোয়েক ড্যামেজ রিস্ক জ়োন’-এ রয়েছে।’’
তবে গবেষকেরা জানাচ্ছেন, বিপদের এখানেই শেষ নয়। কারণ, রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এর রিপোর্ট ইতিমধ্যেই এই তথ্য প্রকাশ্যে এনেছে যে, ১৯৫০-২০১৮, এই সময়সীমায় বিশ্বের শহরগুলির মধ্যে সর্বাধিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে কলকাতার— ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যার মূলে রয়েছে সবুজের হ্রাস এবং কংক্রিটের ক্রমপ্রসারিত সাম্রাজ্য। এর পাশাপাশি ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশন এবং কলকাতা পুরসভার নেতৃত্বাধীন সমীক্ষক-দলের রিপোর্ট জানাচ্ছে, সমীক্ষাধীন ওয়ার্ডগুলির ৩৪ শতাংশের ক্ষেত্রে নিম্নবিত্ত বাসিন্দারা অপরিকল্পিত নিকাশির কারণে বৃষ্টি হলেই সপ্তাহখানেক জলমগ্ন অবস্থায় কাটাতে বাধ্য হন! যার প্রভাব পড়ে তাঁদের কাজে, আয়ে।
অর্থাৎ, এ যেন বায়ু, জল, কম্পন ও তাপ— এই চতুর্ফলায় ‘বিদ্ধ’ কলকাতা! তবে তার পরেও কতটা সচেতন, পরিবেশের প্রতি কতটা সংবেদনশীল শহর?— প্রশ্ন অনেকের। আক্ষেপের সুরে ‘জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষের’ এক পদস্থ কর্তা বলছেন, ‘‘ক্লাইমেট চেঞ্জ শব্দটা আমাদের অভিধানে ঢুকলেও তার ভয়ঙ্কর ফলাফল আমরা আন্দাজ করতে পারছি না। বা পারলেও ইচ্ছাকৃত ভাবে এখনও নির্বিকার, উদাসীন থাকার স্পর্ধা দেখাতে পারছি।’’ কিন্তু সেই স্পর্ধা আর কত দিন? ‘বিপদঘণ্টি’ তো বহু আগেই বাজতে শুরু করেছে। কলকাতা শুনতে পাচ্ছে তো?—সংশয়, ভয় সেখানেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy