ফাইল চিত্র।
আরও একটি পুর ভোটের মরসুম। পরিস্রুত জল, বিদ্যুৎ, পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, সময় মতো জঞ্জাল পরিষ্কারের ঝুড়ি ঝুড়ি প্রতিশ্রুতি নিয়ে আবারও বাসিন্দাদের দরজায় ঘুরছেন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা। পাঁচ বছরের বেশি সময় পার করে হচ্ছে এ বার কলকাতার পুরভোট। কেমন পরিষেবা পেলেন মানুষ? এ শহরের নাগরিক হিসাবে বলব, আগের মতো আর দুর্গন্ধ এড়াতে নাকে রুমাল চাপা দিতে হয় না। গণ শৌচালয় ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে অনেকটাই! জল-নিকাশিও আগের থেকে ভাল।
তবু ‘কেমন আছি কলকাতায়’ বলতে থমকে যেতে হচ্ছেই। ভাল থাকার মানে তো শুধু ত্রিফলা বাতি আর পরিষ্কার রাস্তাঘাট নয়। তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু! ঝলমলে প্রদীপের মতোই বাহ্যিক এই সব চাকচিক্য। নীচের অন্ধকার রয়েই গিয়েছে। নগরায়ণের আড়ালে কি তবে অবহেলিত থেকে যাচ্ছে শহরের মন? অন্তত তথ্য সেই দিকেই ইঙ্গিত করছে। ২০১৫-’১৬ সালে দেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন ৯.৬৭ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ১.২৫ কোটি মানুষই কোনও না কোনও মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৩ শতাংশ। মাদক সেবনের প্রবণতা বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ও আত্মহত্যার ঘটনা, ডিমেনশিয়ার মতো উপসর্গ গ্রামীণ এলাকার চেয়ে বেশি দেখা যায় শহরাঞ্চলে। অথচ সেই সব নিয়ন্ত্রণে সরকারি উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সুসংহত নীতি রয়েছে শুধু গুজরাত আর কেরলে। ফলে সর্বত্র পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তার মতো রোগ। কলকাতাও যার
ব্যতিক্রম নয়।
আমরা মানসিক সমস্যা বলতে মনোরোগ, তার প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা, ওষুধ খাওয়াই বুঝি। এর বাইরেও যে মানসিক বিপন্নতার বিপুল ক্ষেত্র রয়েছে, সেখানে এ সবের পাশাপাশি দরকার শুশ্রূষা। এ জন্য বিগত ১০ বছরেরও বেশি রাজ্যের কয়েকটি পুরসভার সঙ্গে জোট বেঁধে মানসিক ভাবে বিপর্যস্তদের প্রাথমিক শুশ্রূষার কাজে নিয়োজিত এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার জনমানস প্রকল্প। প্রশ্ন হল, ওই সব প্রকল্পকে আমরা কাঠামোবদ্ধ করছি না কেন? এটুকু দাবি তো সরকারের কাছে করাই যায় যে, পুরসভার অধীন শহরকেন্দ্রিক মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি হোক। যেখানে মানুষ নিজের অসুবিধার কথা, বিপর্যয়ের কথা বলতে পারবেন। এখানে হয়তো ওষুধ দেওয়া হবে না, কিন্তু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আশাকর্মীরাই ওই সব কেন্দ্র চালাতে পারবেন। এই বিকল্প পরিসরটা কি গড়ে তোলা যায় না?
আরও একটা কথা বোঝা দরকার। জল, আলো, বিদ্যুৎ, খাদ্য— এ সব কিছুর সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। যত বার এ রাজ্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে, সবচেয়ে বড় ঝক্কিটা পোহাতে হয়েছে প্রতিবন্ধী এবং দরিদ্রদের। আমপান ঘূর্ণিঝড়ের কথা মনে করুন। এমন বিপর্যয় দক্ষ হাতে মোকাবিলা করতে আমাদের রাজ্য এখনও সড়গড় নয়। ওই সময়ে দরিদ্র এবং মানসিক প্রতিবন্ধীরা সরকারি ত্রাণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে ছিলেন। এর প্রভাব তাঁদের মনেও পড়তে বাধ্য। সরকারকে সেই দায়িত্ব নিতে হবে।
একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, ভবঘুরে মানেই মানসিক ভাবে অসুস্থ নন, অশিক্ষিত নন, দরিদ্র নন। তিনি রাস্তায় থাকেন, কারণ ওখানেই ‘নিরাপদ’ বোধ করেন। তাঁরা ঘরবাড়ির ধারণায় আবদ্ধ নন। ওঁদের জোর করে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় আটকানোর চেষ্টা না করে যদি এমন জায়গার ব্যবস্থা করা যায়, যেখানে ওঁরা সামান্য অর্থের বিনিময়ে নিজেদের জিনিস এনে রান্না-খাওয়া করলেন, বিশ্রাম নিলেন, খুব কি অসম্ভব? দু’দিন আগেই কোথাও একটা পড়েছিলাম, পুরসভার অধীনে হাজার তিনেক পরিত্যক্ত বাড়ি আছে। তার কয়েকটি মেরামত করেই তো ব্যবস্থা করা যেতে পারত! কিন্তু এই অবহেলা কি সদিচ্ছার অভাব নয়?
শেষে একটা কথাই বলার। সম্প্রতি মনোসামাজিক প্রতিবন্ধীরা ভোটাধিকার পেয়েছেন। রাজনীতিতে এঁদেরও স্থান সুনির্দিষ্ট। এঁদের প্রতি সরকার যদি দায়িত্ববদ্ধ হয়, ভালবাসা দেখায়, তা হলেই কলকাতা আরও সুন্দর হয়ে উঠবে।
(মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলন কর্মী)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy