দুর্বিষহ: কালীঘাটের কাছে আদিগঙ্গা। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র
কলকাতা পুরসভার পানীয় জলে বিষক্রিয়ার কারণে অসুস্থতার পাশাপাশি মৃত্যু হয়েছে কি না, তা নিয়ে চাপান-উতোর চলছে। বৃহস্পতিবার সংক্রমণের কারণ খুঁজতে নেমে ভবানীপুর এলাকার পানীয় জলের পাইপলাইনে ছিদ্র পাওয়া গেলেও জলে বিষক্রিয়ার কারণেই যে প্রাণহানি হয়েছে, তা মানতে নারাজ পুর কর্তৃপক্ষ।
তবে বিশেষজ্ঞদের একাংশ জানাচ্ছেন, যুক্তির খাতিরে ধরে নেওয়া হল, পুরসভার দাবিই এ ক্ষেত্রে ঠিক। কিন্তু, ভবানীপুর থেকে সামান্য দূরে কালীঘাটের আদিগঙ্গার দূষিত জল (সারফেস ওয়াটার) যে ওই এলাকার ভূগর্ভস্থ জলকেও (গ্রাউন্ড ওয়াটার) ক্রমাগত দূষিত করে চলেছে, যা সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য-বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ, সেই সম্পর্কে তো কোনও বিতর্ক থাকার কথা নয়। কারণ একাধিক সমীক্ষা ইতিমধ্যেই দেখিয়েছে, কী ভাবে আদিগঙ্গার দূষণ শুধু আর আদিগঙ্গার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং, সেই দূষণ ক্রমশ ভূগর্ভস্থ জলাধারকেও গ্রাস করছে। এক বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘পুর কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী মেনে নেওয়া গেল যে, ভবানীপুরের জলে দূষণ নেই। কিন্তু কালীঘাটে জলদূষণের কী হবে?’’
এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞেরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ়’-এর একটি সমীক্ষার প্রসঙ্গ উল্লেখ করছেন। যে সমীক্ষা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল, কী ভাবে আদিগঙ্গার দূষিত জলের ‘অনুপ্রবেশ’ ঘটছে সংলগ্ন এলাকার ভূগর্ভস্থ জলাধারে। ওই সমীক্ষা জানিয়েছিল, এই ‘অনুপ্রবেশ’ ঠেকাতে না পারলে অচিরেই ওই এলাকার ভূগর্ভস্থ জলাধারগুলি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
ওই সমীক্ষায় কী উঠে এসেছিল?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ়’ সূত্রের খবর, তরল নিকাশি বর্জ্য, পুর এলাকার বর্জ্য, শ্মশান-বর্জ্য, মলমূত্র— সব মিলিয়ে আদিগঙ্গা দুর্গন্ধময় এক নিকাশি নালায় পরিণত হয়েছে। ভারী ধাতু, ক্ষার, দ্রবীভূত অক্সিজেন, জৈব অক্সিজেনের চাহিদা (বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড)-সহ জলের গুণগত মানের যে গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠিগুলি রয়েছে, তার সব ক’টি ক্ষেত্রেই আদিগঙ্গার জল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রা অতিক্রম করে গিয়েছে। কিন্তু যেটা উল্লেখযোগ্য তা হল, আদিগঙ্গার সমান্তরাল ভাবে অবস্থিত আংশিক বদ্ধ (সেমি-কনফাইনড) অ্যাকুইফারেও সেই দূষিত জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে প্রবেশ করছে। আর এই পারস্পরিক লেনদেনের ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে এলাকার জলস্তরের বাস্তুতন্ত্র। সমীক্ষার ভাষায়—‘যার ফলে সংলগ্ন ভূগর্ভস্থ জল, যা বর্তমান জলের অন্যতম উৎস এবং যে জল ওই এলাকার জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ ব্যবহার করেন, তা সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে।’
সমীক্ষকেরা জানাচ্ছেন, খিদিরপুর, কালীঘাট, টালিগঞ্জের করুণাময়ী, ইটখোলা, জোকা ও বজবজ— এই ছ’টি জায়গা থেকে (যা ৩১.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত) একই সঙ্গে আদিগঙ্গার জল ও সংলগ্ন ভূগর্ভস্থ জলের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সেখানেই এই দূষণ-চিত্র ধরা পড়েছিল, যার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। যাদবপুরের ‘স্কুল অব এনভায়রনেমন্টাল স্টাডিজ়’-এর অধ্যাপক-গবেষক তড়িৎ রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘শহরের বর্জ্য ব্যবস্থার উপরে গুরুত্ব না দিলে আদিগঙ্গার দূষণের মাত্রা অব্যাহত থাকবেই। এর পাশাপাশি নিকটস্থ যে ভূগর্ভস্থ পানীয় জলাধার রয়েছে, তা-ও ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়বে।’’
নদী-বিশেষজ্ঞ সুপ্রতিম কর্মকার আবার বলছেন, ‘‘আদিগঙ্গা সংলগ্ন এলাকার কলের জলে যে ভ্যাপসা গন্ধ থাকে, তার অন্যতম কারণই হল, ভূগর্ভস্থ জলেও ক্রমশ দূষণ ছড়াচ্ছে।’’ এ প্রসঙ্গে জানতে কলকাতা পুরসভার জল সরবরাহ দফতরের এক শীর্ষ কর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টি না জেনে কোনও মন্তব্য করব না।’’
জাতীয় পরিবেশ আদালতে আদিগঙ্গা নিয়ে মামলা চলাকালীন আদালতবান্ধব হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। তিনি বলেন, ‘‘আদিগঙ্গার সংস্কার কোনও দিনই হবে না। কারণ, এই রাজ্যে পরিবেশের বিষয়গুলিরও রাজনীতিকরণ করা হয়। আর সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য-সুরক্ষার বিষয়টি গৌণ হয়ে যায়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy