নির্বিচারে: যশোর রোডের ধারে এ ভাবেই কাটা পড়েছে একের পর এক গাছ। ছবি: সুদীপ ঘোষ
কথা ছিল। রাখেনি কেউ। গাছ কাটা হয়েছে কয়েক হাজার, কিন্তু পরিবর্তে পোঁতা হয়নি একটিও। এটাই যেন দস্তুর উত্তর ২৪ পরগনায়।
বন দফতরের পরিসংখ্যানই বলছে, এই জেলায় গত ১২ বছরে (চলতি বছরের জুন পর্যন্ত) রাস্তা সম্প্রসারণ বা ‘উন্নয়নের’ কাজে কাটা পড়েছে ৩৭ হাজার ৭৪২টি গাছ। বেসরকারি মতে অবশ্য সংখ্যাটা দ্বিগুণেরও বেশি। যশোর রোড, বারাসত-টাকি রোডের মতো রাস্তায় কোথাও কোথাও আদালতের নির্দেশে গাছ কাটা সাময়িক ভাবে বন্ধ থাকলেও অন্যত্র তা চলছে নির্বিচারে। কাটা গাছ বিক্রি হচ্ছে লক্ষ টাকায়। জেলা বনাধিকারিক অংশুমান মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রাস্তা উন্নয়নের কাজে একটি গাছ কাটা হলে পরিবর্তে পাঁচটি গাছ লাগানোর নিয়ম।’’ কিন্তু, তা রয়েছে খাতায়-কলমেই। গোটা এলাকা ঘুরে একটি নতুন গাছেরও দেখা মিলল না।
বারাসত থেকে বনগাঁ পর্যন্ত ৫৬ কিলোমিটার যশোর রোড এমনিতেই হকার ও দখলদারিতে দীর্ণ। নিত্য লেগে থাকে তীব্র যানজট। এই অবস্থায় যশোর রোড সম্প্রসারণ গুরুত্বপূর্ণ, মানছেন অনেকেই। সেই কাজেই কাটা পড়বে ৪,০৩৬টি গাছ। প্রাথমিক পর্যায়ে পাঁচটি উড়ালপুল তৈরির জন্য কাটা হচ্ছিল ৩৫৬টি গাছ। অভিযোগ, যেহেতু হকার সরিয়ে রাস্তা সম্প্রসারণে রাজনৈতিক বাধা আসছে, তা এড়াতে গাছকেই করা হচ্ছে বলি।
গাছ ‘বলি’
১২ বছরে কাটা হয়েছে ৩৭,৭৪২টি গাছ
• বারাসত-টাকি রোড ১৫১৪
• বারাসত-বনগাঁ যশোর রোড ৩৫৬
• গত বছর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৩১০২
সূত্র: বন দফতর
অতীতে গাছ কাটার পরে নতুন গাছ না লাগানোর তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বার গাছ কাটার বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলনে নেমেছেন এই জেলার ছাত্রছাত্রী, স্থানীয় লোকজন ও মানবাধিকার সংগঠনগুলি। বহুমূল্য গাছগুলি না কেটে রাস্তা সম্প্রসারণের দাবিতে গড়ে ওঠে ‘যশোর রোড গাছ বাঁচাও কমিটি’। কমিটির অভিযোগ, নির্বিচারে গাছ কাটা হলে পরিবেশে তার কতটা প্রভাব পড়বে, সেই সমীক্ষা না করেই যথেচ্ছ ভাবে কাটা চলছে রাস্তার দু’ধারের প্রাচীন সব গাছ।
আন্দোলনকারীদের প্রতিবাদ যে যুক্তিযুক্ত, তার সমর্থন মিলেছে জেলা ঘুরে। কয়েক বছর আগে বনগাঁ থেকে চাকদহ পর্যন্ত ৩১ কিলোমিটার রাস্তার কাজের জন্য কাটা পড়েছিল ৬৮৬টি গাছ। সেগুলি বিক্রি হয় দেড় কোটি টাকায়। ওই এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, পরিবর্তে একটি গাছও পোঁতা হয়নি। একই ভাবে গাছ পোঁতা হয়নি ভিআইপি রোড, ৩৪ ও ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়কেও।
বন দফতরের বক্তব্য, কয়েক বছর আগে দুই জাতীয় সড়কে মোট ২৩০টি গাছ কাটা হয়েছিল। সেগুলির গুঁড়ির গড় বেড় ছিল সাড়ে চার মিটার। এর মধ্যে মেহগনি ছাড়াও বিশাল উচ্চতার আম, বট, অশ্বত্থ, নিম, শিরীষ, বাক্স বাদাম ও হিমঝুরির মতো দুর্লভ গাছও ছিল। সেই গাছ ৪০ লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়। তার পরিবর্তে পাঁচটি করে মোট ১১৫০টি গাছ লাগানোর কথা ছিল। অভিযোগ, সেটুকু কর্তব্যপালনও হয়নি।
গরম কিংবা বিশ্ব উষ্ণায়নের মোকাবিলায় গাছের ভূমিকা অসামান্য, বলছেন বটানিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার প্রাক্তন অধিকর্তা এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞানী দুলালচন্দ্র পাল। তাঁর কথায়, ‘‘এমন বিশাল বিশাল গাছ কাটা পড়ায় প্রায় সাড়ে সাতশো প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি বিপন্ন হচ্ছে। এত বড় ক্ষতির পরে ফের গাছ পুঁতে সামান্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাটুকুও করা হয়নি।”
কী বলছে প্রশাসন?
উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক চৈতালি চক্রবর্তী বলেন, ‘‘রাস্তার কাজের জন্য যাঁরা গাছ কেটেছেন, পরিবর্তে কোথায় কত গাছ লাগিয়েছেন তাঁরা, জানতে চাওয়া হচ্ছে।’’ বন দফতর জানিয়েছে, গত তিন বছরে ৪২টি সরকারি-বেসরকারি সংস্থা এই জেলায় গাছ কেটেছে। পরিবর্তে তারা কোথায় বৃক্ষরোপণ করেছে, জানতে চাওয়া হয়েছে তা-ও। সেই রিপোর্ট ধরে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে তিন বছর আগে কেটে ফেলা গাছগুলির পরিবর্তে গাছ লাগানোর দায় কে নেবে, সেই জবাব অবশ্য মেলেনি প্রশাসনের কাছ থেকে।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy