(উপরে বাঁ দিক থেকে) কিঞ্জল নন্দ, অনিকেত মাহাতো, (নীচে বাঁ দিক থেকে) দেবাশিস হালদার এবং রুমেলিকা কুমার। —ফাইল চিত্র।
মনের ভিতরে জমে থাকা ক্ষোভ প্রতিবাদ হয়ে বেরিয়ে এসেছিল জনসমক্ষে। গাছের নীচে জড়ো হয়ে জনা পনেরো চিকিৎসক-পড়ুয়া সঙ্কল্প করেছিলেন, তাঁরা নিজেদের কথা নিজেরাই বলবেন। জোর গলায় আওয়াজ তুলে বিচার চাইবেন তাঁদেরই সতীর্থ চিকিৎসক-পড়ুয়ার খুন-ধর্ষণের ঘটনার।
খালধারের মেডিক্যাল কলেজ আর জি করের এই পড়ুয়ারা গত ১০ অগস্ট থেকে এ ভাবেই শুরু করেছিলেন প্রতিবাদ-আন্দোলন। তাতে একে-একে যোগ দিয়েছেন অন্য মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক-পড়ুয়ারাও, যাঁদের অনেকেই আগে কোনও দিন রাজনীতির আঙিনায় পা রাখেননি। কেউ কেউ আবার এমবিবিএস পড়ার সময়ে সক্রিয় রাজনীতি করেছেন। কিন্তু আর জি করের ঘটনার প্রতিবাদে এক মঞ্চে বসার সময়ে সকলেই ভুলে গিয়েছিলেন নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয়। রাজনীতির রং, মতাদর্শ দূরে সরিয়ে রেখে সমস্বরে স্লোগান তুলেছিলেন, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। যা আজ ‘সর্বজনীন’।
আর জি করের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরের দিন অ্যানাটমি বিল্ডিংয়ের সামনের গাছতলায় জড়ো হয়ে আন্দোলনের সলতে পাকানো হয়েছিল। মঙ্গলবার অবস্থান মঞ্চের অদূরে দাঁড়িয়ে সে কথাই বলছিলেন আর জি করের মাইক্রোবায়োলজির স্নাতকোত্তর স্তরের চিকিৎসক-পড়ুয়া কিঞ্জল নন্দ। তিনি বললেন, ‘‘ওই দিন ঠিক করেছিলাম, আজ যদি এমন ঘটনার প্রতিবাদ করতে না পারি, তা হলে ভবিষ্যতে কোনও দিন নিজেদের কথা নিজেরা বলতে পারব না।’’ কিঞ্জল ২০১০ সালে কে পি সি মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস পড়তে ভর্তি হন। তার আগে থেকেই থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত থাকায় এখন টলিউডে অভিনয় জগতের পরিচিত মুখ কিঞ্জল অবশ্য কখনও সক্রিয় রাজনীতি করেননি। বললেন, ‘‘অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করার জন্য যদি আবারও কখনও কোনও আন্দোলনে নামতে হয়, আমি আছি।’’
তাঁরই সতীর্থ, অ্যানাস্থেশিয়োলজির স্নাতকোত্তর স্তরের চিকিৎসক-পড়ুয়া অনিকেত মাহাতোর কথায়, ‘‘এমন ঘটনার পরেও যদি চুপ করে থাকতাম, তা হলে অন্য সতীর্থদের কী উত্তর দিতাম? সেই উত্তর খুঁজতে গিয়েই সকলে এক হয়েছিলাম।’’ ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা অনিকেত ২০১২ সালে এসএসকেএমে এমবিবিএস পড়ার সময়ে ‘ডিএসও’র মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন। সেই সূত্রেই শিখেছেন নিজেদের দাবিগুলি কী ভাবে তুলে ধরতে হয়। কিন্তু আর জি করের ঘটনায় দলীয় সঙ্কীর্ণতা সরিয়ে রেখেই ন্যায়ের দাবিতে সকল সতীর্থ সহমত হয়ে পথে নেমেছিলেন বলে জানান অনিকেত। যা আজ বৃহত্তর আন্দোলনের রূপ নিয়েছে।
খুন ও ধর্ষণের ঘটনার প্রকৃত বিচারের দাবিতে তৈরি হওয়া প্রতিবাদে সময়ের সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে অন্যান্য ক্ষোভও। প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে হুমকির পরিবেশ তৈরির বিরোধিতা থেকে বিভিন্ন দুর্নীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে যুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতেও আওয়াজ তুলতে থাকেন হাজারো জুনিয়র চিকিৎসক। তাই প্রতি দু’ঘণ্টা অন্তর মা ফোন
করলে তাঁকে নিজেদের দাবি বুঝিয়ে রাস্তায় বসে বিচারের স্লোগান তুলেছেন শল্য বিভাগের আর এক পিজিটি লহরী সরকার। পাঠভবনের প্রাক্তনী ওই তরুণী চিকিৎসক-পড়ুয়া কোনও দিনও রাজনীতি করেননি। বাড়িতেও সেই পরিবেশ নেই। কিন্তু আর জি কর জুড়ে সন্দীপ ঘোষ ও তাঁর বাহিনীর দ্বারা যে ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে রাস্তায় নামার সঙ্কল্প নিয়েছিলেন লহরী। বললেন, ‘‘আন্দোলন শুরুর গোড়ার দিকে বৈঠকে অন্য কলেজের সতীর্থেরা অধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবি তুললে সন্দীপ-বাহিনী ঝামেলা করেছিল। স্নাতক স্তরের পড়ুয়াদের হুমকি দিতে শুরু করেছিল। কিন্তু আমরা থামিনি।’’
রীতিমতো ভোটাভুটি করে সন্দীপ বা ‘উত্তরবঙ্গ লবি’-র চিকিৎসক-পড়ুয়াদের এক-এক করে
‘জেনারেল বডি’ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বলে জানাচ্ছেন কলকাতা মেডিক্যালের সিনিয়র রেসিডেন্ট দেবাশিস হালদার। বলাগড়ের বাসিন্দা, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ওই কৃতী পড়ুয়া কলকাতা মেডিক্যালে ‘রেসিডেন্ট ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন’ (আরডিএ) তৈরির জন্য ‘ডিএসএ’র হয়ে আন্দোলন করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের এই আন্দোলনে ন্যায় বিচারের দাবিই মুখ্য। তার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক খোঁজা উচিত নয়।’’ একই ছাত্র সংগঠনের সদস্য রুমেলিকা কুমারেরও দাবি, তাঁরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। রাজনৈতিক স্বার্থে নয়। ২০১৩-য় কলকাতা মেডিক্যালে ডাক্তারি পড়ার সময়েই ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ তাঁর। ২০১৮-য় হস্টেল নিয়ে আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিলেন।
মুর্শিদাবাদের অস্থায়ী বিড়ি শ্রমিকের বড় ছেলে গৌরাঙ্গ প্রামাণিকের ২০০৪ সালে ডাক্তারিতে ভর্তির সময়েই ‘ডিএসও’ সংগঠনের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি। কিন্তু রাজনৈতিক পরিচয়ে নয়, বরং স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দুর্নীতির আখড়া ভাঙার লড়াইয়ে শামিল হতেই ছুটে এসেছেন বলে জানালেন বর্ধমান মেডিক্যালের পিজিটি গৌরাঙ্গ। সতীর্থদের মতো কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ তাঁর নেই। কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী রাজনীতিতে সব সময়ে আছেন বলে জানালেন আর জি করের ইএনটি-র পিজিটি আসফাকুল্লা নাইয়া। যিনি মনে করেন, আর জি করের ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলন সাধারণ মানুষের রক্তে ঢুকে গিয়েছে। কাকদ্বীপের প্রত্যন্ত গ্রামের ওই যুবকের কথায়, ‘‘সাফল্য যদি সুন্দর ফুল হয়, বিনম্রতা তার সুগন্ধ। এই মনোভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর থেকে দাবি আদায় করে আনতে পেরেছি।’’
তবে, ওঁরা কেউই নিজেদের আন্দোলনের মুখ বলে মানতে নারাজ। বরং বলছেন, ‘‘অন্যায়ের মুখোশ খুলতে সমস্ত জুনিয়র চিকিৎসকই আন্দোলনের মুখ।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy