আড্ডায় তিন ভাই। প্রীতীশ নন্দী (বাঁ দিক থেকে), মণীশ নন্দী ও আশিস নন্দী। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে, শনিবার। -নিজস্ব চিত্র।
না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘খুব প্রিয়’ বলিউডও আর তাঁর পাশে দাঁড়াচ্ছে না। বলিউডের প্রথম সারির অভিনেতা, অভিনেত্রীরা বরং দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছেন মোদী ও তাঁর দল বিজেপির থেকে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) নিয়ে দেশজোড়া আলোড়নের সময়েই এটা ষ্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। শুধুই বলিউড নয়, দেশের সব প্রান্তের প্রথম সারির শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, অধ্যাপকরাই মুখ ফেরাচ্ছেন বিজেপি থেকে।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রাঙ্গণে শনিবার এ কথা বললেন একটি সর্বভারতীয় পত্রিকার এক সময়ের এডিটর-ইন-চিফ, ‘পদ্মশ্রী’ পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক প্রীতীশ নন্দী। ‘তিন ভাই, তিন শহর, তিনটি জীবন’ আড্ডায়। সেই আড্ডা শুরুর ‘রেফারি’ ছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী।
দিল্লির বাসিন্দা বড়দা বিশিষ্ট সমাজতত্ত্ববিদ আশিস নন্দী আর ওয়াশিংটনই যাঁর ঘর-বাড়ি গত ৪০ বছরের, সেই মেজদা, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের উপদেষ্টা মণীশ নন্দীর সঙ্গে প্রায় ঘণ্টাদেড়েক আড্ডা মারলেন মুম্বইয়ের প্রীতীশ। একরাশ মানুষের সামনে। কোনও রাখঢাক না রেখে বোঝালেন, ভক্তি ও স্তুতিতে গদগদ না হয়ে এখনও স্পষ্টবক্তা হিসাবেই পরিচিত ও ‘নিন্দিত’ (!) হতে চান তিনি।
সিএএ বিরোধী আন্দোলন। পঞ্জাবে। ছবি-পিটিআই
সিএএ, এনআরসি-র পর দেশের শিল্পী, বুদ্ধিজীবী মহলে মোদী সরকারের গ্রহণযোগ্যতা কোথায় নেমেছে তা বোঝাতে একটা গল্প শোনালেন প্রীতীশ। বললেন, বলিউডের বড় বড় তারকাদের নিয়ে একটা খুব জমকালো বৈঠক ডাকার কথা ভেবেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। উদ্দেশ্য ছিল, ওঁদের বোঝাবেন কেন সিএএ, এনআরসি চালু করা হচ্ছে। সেই মতো প্রস্তুতি শুরু হল। কিন্তু দিনকয়েক পরেই খবর পেলেন, তেমন লোকজন হবে না বৈঠকে। কেউ আসতে চাইছেন না। বেগতিক বুঝে মুম্বই আসার সূচি বাতিল করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রতিনিধি হিসাবে পাঠালেন রেলমন্ত্রী পীযূষ গয়ালকে। কিন্তু গয়ালের বৈঠকেও বলিউডের কোনও প্রথম সারির অভিনেতা, অভিনেত্রী এলেন না। প্রীতীশের কথায়, ‘‘যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা সকলেই বলিউডের থার্ড বা ফোর্থ গ্রেডের অভিনেতা, অভিনেত্রী। এটা শুধু বলিউডের ক্ষেত্রে ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না। গোটা দেশের শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, বিজ্ঞানী মহলেই এই সরকারের (পড়ুন মোদী সরকারের) গ্রহণযোগ্যতা বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। জরুরি অবস্থার সময় যেমন প্রতিবাদ জানাতে দেখা গিয়েছিল কিশোর কুমারকে। তার পর অনেক দিন এটা দেখা যায়নি বলিউডে।’’
আরও পড়ুন- দেশভক্তির প্রমাণ কি শুধু তেরঙায়
আরও পড়ুন- মোদী-মমতার বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলনের ডাক
ছোট ভাই প্রীতীশের সুরে সুর মেলালেন মেজদা মণীশ নন্দীও। দীর্ঘ ৪০ বছর আমেরিকা-সহ বিভিন্ন দেশের কর্পোরেট জগতে পরিচিত নাম মণীশও মনে করেন, ধর্মের নামে নাগরিকত্ব বাছবিচারের যে পথ নেওয়া হয়েছে, তা দেশের অর্থনীতির পক্ষেও হয়ে উঠতে চলেছে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। কারণ, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ১২৫ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতে আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন ধর্মের জিগিরে এ দেশের বাজার খণ্ডিত হয়ে গেলে। কোনও বিদেশি বিনিয়োগকারীই চান না বাজার খণ্ডিত হোক। তাতে তাঁদের মুনাফা কমবে। অর্থনীতিতে মাথা তুলে দাঁড়ানোর কথা বার বার বলা হচ্ছে। অথচ তার জন্য যে বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন যথেষ্টই, তা মাথায় রাখা হচ্ছে না। হলে, এই ভাবে ধর্মের নামে বিভাজনের রাস্তা বেছে নেওয়া হত না।
তিন ভাইয়ের আড্ডা শুরু করলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী (পিছনে)। শনিবার। -নিজস্ব চিত্র।
‘‘তবে দু’সময়ের মধ্যেই আশার আলো বেরিয়ে আসে। কেউ তা জ্বালিয়ে দেয়। সেটাই জীবনের নিয়ম। না হলে দুঃসময় কাটত না কোনও দিনই’’, বললেন প্রীতীশের বড়দা আশিস নন্দী।
তাঁর মতে, সেই আশার আলো জাগিয়েছে দিল্লির শাহিনবাগ। আশিসের কথায়, ‘‘শাহিনবাগ উত্তরোত্তর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের মতো হয়ে উঠছে। মহাত্মা গাঁধী, আচার্য বিনোবা ভাবেকে জেলে পুরে ব্রিটিশরা ভেবেছিল, ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে থিতিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু তা হয়নি। কোনও জায়গায় স্থানীয় স্তরের নেতা, কর্মী, সমর্থকদের গ্রেফতার করার পর তা অন্যান্য জায়গায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। একই ভাবে দিল্লিতে শুরু হয়ে শাহিনবাগ এখন পৌঁছে গিয়েছে কলকাতায়।’’
দিল্লির শাহিনবাগের প্রতিবাদ। ছবি- এপি।
তা আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ভারতের অন্যান্য শহরে। আশিস জানান, দিল্লির শাহিনবাগেই ধর্না প্রথম শুরু হয়। পরে তা কলকাতায় আসে। যদিও শাহিনবাগ বলে কোনও জায়গাই নেই কলকাতায়। তার পর বেঙ্গালুরুতে হল ‘শাহিনবাগ’। আবার মুম্বইতেও যে ধর্না চলছে, তাকে ‘মুম্বইবাগ’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আশিসের কথায়, ‘‘শাহিনবাগ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ার কোনও লক্ষণ নেই। বরং প্রচুর মহিলা এতে অংশ নেওয়ায় এই আন্দোলন একটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে।’’
প্রীতীশ মনে করেন, এই পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যমের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া উচিত। যদিও তাঁর কথায়, ‘‘সংবাদমাধ্যমের একাংশকে নানা কারণে সেই দায়িত্ব পালনে দ্বিধাগ্রস্ত হতে দেখা যাচ্ছে। এটা কাটিয়ে ওঠা দরকার।’’
আড্ডা় শুরুর সময় ‘রেফারি’ সব্যসাচীর প্রয়োজন হয়েছিল। শেষ করার সময় কাউকে লাগল না নন্দী ভাইদের।
‘‘এ বার আড্ডা শেষ করা যাক, রাত হয়ে এল’’, শেষেও সুর মিলে গেল আশিস, মণীশ, প্রীতীশের।
‘রেফারি’কে হুইস্ল বাজাতে হল না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy