লড়াই: হাসপাতালে থাকাকালীন নতুন করে হাঁটা শিখেছেন অমিতাভবাবু। নিজস্ব চিত্র
লোকসভা ভোট-পরবর্তী হিংসা স্তব্ধ করে দিয়েছিল একটি পরিবারকে। দুই গোষ্ঠীর গোলমালের মধ্যে পড়ে লাঠির ঘায়ে গুরুতর জখম হয়েছিলেন দুর্গাপুর ‘এ’ জ়োনের সার্কল ইনস্পেক্টর (সিআই) অমিতাভ সেন। ঘটনাটি গত বছরের জুন মাসের। কোমায় চলে যাওয়া পুলিশ আধিকারিক যে কখনও উঠে দাঁড়াতে পারবেন, আশা করেননি স্ত্রী লাবণ্য সেন। সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করল চিকিৎসা বিজ্ঞান।
লাবণ্য জানান, ওই গোলমালে অভিযুক্তদের ধরতে গত ১৭ জুন রাতে লাউদোহার পাটশেওড়া গ্রামে যান অমিতাভ। পুলিশি পদক্ষেপ ঘিরে উত্তেজনা তৈরি হয়। গোলমালের মধ্যে লাঠির ঘায়ে আক্রান্ত হন কর্তব্যরত সিআই। তাঁর মস্তিষ্কের ডান দিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্গাপুরের বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পরে চিকিৎসকেরা জানান, প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় রোগী কোমায় চলে গিয়েছেন। প্রায় এক মাস ওই হাসপাতালে ভর্তি থাকার পরে আর যে বিশেষ কিছু করণীয় নেই, সে কথা পরিবারকে জানিয়েছিলেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
হাল না ছেড়ে অমিতাভকে মল্লিকবাজারের ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সে ভর্তি করায় পরিবার। ৫২ বছরের পুলিশ আধিকারিককে যখন ওখানে আনা হয়, তখন তিনি হাত-পা নাড়ানো তো দূর, চোখের পাতা পর্যন্ত খুলতে পারছিলেন না। চিকিৎসা পরিভাষায়, রোগী এসেছিলেন ‘লিভিং ডেথ’ অবস্থায়। সেই শরীরে প্রাণ সঞ্চার করল হাসপাতালের ‘নিউরো রিহ্যাবিলিটেশন’ বিভাগ। ছ’মাস চিকিৎসার পরে সম্প্রতি বাড়ি ফিরেছেন অমিতাভ। ধীরে ধীরে হাঁটাচলাও শুরু করেছেন। তা দেখে প্রাণ জুড়োচ্ছে অশীতিপর মায়ের। স্ত্রী পিঠে হাত রেখে জানতে চাইছেন, ‘‘থানায় যাবে না? তোমাকে আবার থানায় যেতে হবে কিন্তু।’’ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাচ্ছেন অমিতাভ।
‘নিউরো রিহ্যাবিলিটেশন’ বিভাগের অধিকর্তা চিকিৎসক সুপর্ণ গঙ্গোপাধ্যায় জানান, অমিতাভ যে ধরনের আঘাত পেয়েছিলেন, তাকে ‘সিভিয়র ট্রমাটিক ব্রেন ইনজুরি’ বলা হয়। সুপর্ণবাবুর কথায়, ‘‘মস্তিষ্কের ডান দিকে এত রক্তক্ষরণ হয়েছিল যে, মাঝের অংশ বাঁ দিকে সরে যায়। একে বলে মিড-লাইন শিফট। অবিরাম রক্তক্ষরণে অমিতাভর ক্ষেত্রে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে দ্রুত অস্ত্রোপচার না করলে প্রাণসংশয় হতে পারে।’’
অধিকর্তা জানান, প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার দুর্গাপুরের হাসপাতালে হয়েছিল। কিন্তু আঘাত এতই গুরুতর ছিল যে মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল, টেম্পোরাল এবং প্যারাইটাল লোব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার জেরে যাবতীয় সংবেদনশীলতা হারান রোগী।
এই পরিস্থিতিতে ধীরে ধীরে সংবেদনশীলতা ফিরিয়ে আনার কাজ রিহ্যাবের মাধ্যমে শুরু হয়। বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের কথায়, ‘‘স্বাদ, গন্ধ, স্পর্শ-সহ প্রতিটি অনুভূতি ফেরানোর নির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। সেটাই ফিজিয়োথেরাপি, স্পিচ থেরাপি, অকুপেশনাল এবং মিউজিক থেরাপির মাধ্যমে করা হয়েছে।’’
তবে কোমায় চলে যাওয়া রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার পিছনে কয়েকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাসপাতালের এক চিকিৎসকের বক্তব্য, মস্তিষ্কের আঘাত কত গভীর এবং আঘাতপ্রাপ্ত স্থানের অস্ত্রোপচার কতটা সফল, সেটি বিচার্য। ঠিক সময়ে রিহ্যাব শুরু না হলে জটিলতা বাড়তে পারে। ওই চিকিৎসকের কথায়, ‘‘রিহ্যাবের জন্য ধৈর্যের দরকার। আর্থিক সামর্থ্য এবং রোগীর মনোবলও জরুরি। তবে এটাও বাস্তব, রিহ্যাবের ব্যয়বহুল চিকিৎসা অনেকে বহন করতে পারেন না।’’
লাবণ্য জানান, কলকাতায় আসার এক মাস পরে প্রথম চোখ খোলেন অমিতাভ। দুই সন্তানের মধ্যে দন্ত চিকিৎসার ছাত্রী অরিপ্রা সেনকে প্রথম চিনতে পারেন। তাঁর চিকিৎসায় আগাগোড়া পাশে ছিল রাজ্য পুলিশ দফতর। তার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কৃতজ্ঞ অমিতাভর পরিবার। কিন্তু একই সঙ্গে লাবণ্য বলছেন, ‘‘রাজনীতির কারণে একটি পরিবার প্রায় অনাথ হতে বসেছিল। পুলিশকর্মীরা যা করেন, চাকরির দায়বদ্ধতা থেকে করেন। তাঁদের উপরে এমন আক্রমণ কেন?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy