টিভির পর্দায় চোখ রেখে সবে চায়ে চুমুক দিয়েছেন। পাশের ঘর থেকে লাফিয়ে এসে মেয়ে বলল, ‘আমায় একটা বয়ফ্রেন্ড খুঁজে দাও তো। লাইফটা কেমন একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে’। গড়িয়ার বাসিন্দা, পেশায় ব্যাঙ্ক কর্মী অনিতা রায় (নাম পরিবর্তিত) ক্লাস ফাইভে পড়া দশ বছরের মেয়ের কথা শুনে চমকে উঠেছিলেন। কেন হঠাৎ এই কথা, জানতে চাওয়ায় মেয়ে তিথি (নাম পরিবর্তিত) তাঁকে বলে, ‘‘বয়ফ্রেন্ড না থাকলে বন্ধুদের কাছে মান থাকছে না মা। তা ছাড়া বয়ফ্রেন্ড থাকলে জীবনে অনেক ‘ফান’ থাকে।’’
মেয়ের কথায় প্রথমে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন অনিতাদেবী। পরে মনকে বুঝিয়েছেন, এই সমস্যা তিনি একা মেটাতে পারবেন না। অগত্যা অফিস শেষে এক দিন হাজির হলেন মনোচিকিৎসকের ক্লিনিকে। তাঁকে সবটা খুলে বললেন। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো কয়েক বার তাঁর কাছে মেয়েকেও নিয়ে গেলেন। এখন অনেকটাই সুস্থ তিথি। সে ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছে, কী ভাবে সম্পর্ক গড়তে হয়।
তিথির থেকে গল্পটা অনেকটাই আলাদা আকাশের (নাম পরিবর্তিত)। অঙ্ক স্যারের কাছে পড়তে যেতে ভাল লাগত না তার। এমনিতে অঙ্ক বিষয়টা ভালবাসে আকাশ। স্যারও খুব প্রশংসা করতেন। তবু তাঁকে ভাল লাগত না। পড়তে গেলেই ঘরের দরজা বন্ধ করে স্যার এমন ভাবে আদর করতেন, বড্ড অস্বস্তি হতো ওর।
দিনের পর দিন এমন চললেও আকাশ বুঝতে পারত না, কী ভাবে এই কথাগুলো বাড়িতে বলবে। একটা সময়ে বাড়ির লোক দেখলেন, বছর আটেকের ছোট্ট হাসিখুশি ছেলেটা কেমন গুটিয়ে গিয়েছে। হয়ে উঠেছে অসহিষ্ণু। পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়ায় বাবার বকুনি খেয়ে ফুলদানি ছুড়ল তাঁর দিকে। সব দেখেশুনে মা শম্পাদেবীর (নাম পরিবর্তিত) মনে সংশয় দানা বাঁধল, তবে কি কোথাও কোনও গোলমাল হচ্ছে?
কালবিলম্ব না করে শম্পাদেবী ছেলেকে নিয়ে গেলেন তাঁর এক মনোবিদ বন্ধুর কাছে। তিনি আকাশের সঙ্গে বন্ধুত্ব জমিয়ে জেনে নিলেন ওর মনের কথা। আকাশ ওই চিকিৎসককে একটি হিন্দি সিনেমার দৃশ্য টেনে বলে, ‘‘মা বলেছিল ওরা নোংরা কাজ করছে। ওগুলো দেখতে নেই। কিন্তু স্যারও তো আমার সঙ্গে ওরকম করেই আদর করত। আমার ভাল লাগত না।’’ সেই চিকিৎসার তত্ত্বাবধানে থেকে আকাশ এখন অনেকটাই ভাল। সচেতন হয়েছেন তার মা-বাবাও। ফি-দিনের রুটিনে একটা সময় বরাদ্দ রেখেছেন ছেলের সঙ্গে কাটানোর জন্য। স্কুলই হোক বা পড়া, প্রতিদিনের খুঁটিনাটি তাঁরা জানতে চান আকাশের থেকে।
আকাশ আর তিথির থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে থাকে লিজা আর জন (নাম পরিবর্তিত)। তাদের সমস্যাটা সেই একই। বন্ধুদের সামনে নিজের ‘সম্মান’ বাঁচাতে মরিয়া ছিল লন্ডনের বাসিন্দা, ১২ বছরের জন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গার্লফ্রেন্ড জোটাতে না পেরে সে অবসাদে ভোগে। লিজা আবার নিত্য দিন শারীরিক হেনস্থার শিকার হতো দাদার কাছে। স্কুলে গিয়ে সেই যন্ত্রণার রাগ মেটাত বন্ধুদের সঙ্গে মারামারি করে। স্কুলের শিক্ষিকা এই আচরণ লক্ষ করে লিজাকে নিয়ে যান এক মনোচিকিৎসকের কাছে।
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, আধুনিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত কিশোর-কিশোরীদের মনে নানা মানসিক টানাপড়েন তৈরি হচ্ছে। বিশেষত, বাড়ছে বয়ঃসন্ধির আগেই সম্পর্ক তৈরির প্রবণতা। সম্প্রতি একটি বেসরকারি সংস্থা স্কুল-পড়ুয়াদের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে, ভারতে প্রায় ৬০ শতাংশ পড়ুয়া বালক-বালিকা সম্পর্কের টানাপড়েনে ভুগছে। কেউ বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদের জেরে, কেউ আবার অন্যের দেখাদেখি সঙ্গী খুঁজছে নিছকই ‘স্টেটাস’ বজায় রাখতে। বাল্যকালেই তারা প্রাপ্ত বয়সের স্বাদ পেতে চাইছে। অথচ বড় হয়ে ওঠার সমস্যাগুলো সামলাতে পারছে না। যার ফল, আসক্ত হয়ে পড়ছে তারা পর্নোগ্রাফিতে।
এই জটিল সমস্যা থেকে বেরোনোর পথ খুঁজতে একসঙ্গে হাঁটতে চলেছেন ভারত ও ইংল্যান্ডের মনোবিদ, মনোচিকিৎসক এবং মেডিসিনের চিকিৎসকদের একাংশ। কী ভাবে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকেরা বুঝতে পারবেন শৈশবের সমস্যা, তা নিয়ে ভারতের বিভিন্ন শহরে জানুয়ারি মাস থেকে যৌথ ভাবে চর্চা শুরু হবে। এ বিষয়ে আগ্রহী এ দেশের চিকিৎসকেরা যাতে দেশে থেকেই ‘সাইকো-সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিলেশনশিপ’ থেরাপির উপরে দু’বছরের ডিপ্লোমা কোর্স করতে পারেন, তার ব্যবস্থা করছে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়।
এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত মনোবিদ রিমা হকিংস। দীর্ঘ দিন লন্ডনে থেকে চর্চা করেছেন এই প্রবাসী বাঙালি। রিমাদেবীর কথায়, ‘‘আপাতদৃষ্টিতে লন্ডন আর কলকাতা আলাদা। কিন্তু মনের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, দুই শহর মিশে গিয়েছে। অভিভাবক, স্কুল কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি আমাদেরও চর্চা করা উচিত এই পরিস্থিতি কী ভাবে সামলাব, তা নিয়ে।’’ রিমাদেবীর সঙ্গে একমত কলকাতার মনোচিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘সঙ্গী থাকা এখন একটা স্টেটাসে পরিণত হয়েছে। শৈশবেই বাচ্চারা সঙ্গী খুঁজতে মরিয়া। সম্পর্ক কী, কেন সেই সম্পর্কে জড়াব— না বুঝে তারা আনন্দের জন্যই সম্পর্ক তৈরি করে ফেলছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy