Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
Kolkata

পাভলভের খেলার আসর মুছে দিল রোগীর তকমা

সব মিলিয়ে জনা ৮০ আবাসিক স্পোর্টসে শামিল হয়েছিলেন। সকালে কয়েক জন ছবি আঁকার আসরে বসেন। দুপুরে হাল্কা জলযোগ সেরে আবার মাঠে।

বন্ধন: ডাক্তার ও সুহৃদদের সঙ্গে খেলার আসরে পাভলভের আবাসিকেরা।

বন্ধন: ডাক্তার ও সুহৃদদের সঙ্গে খেলার আসরে পাভলভের আবাসিকেরা। নিজস্ব চিত্র।

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৭:৪২
Share: Save:

শীতের শেষ বেলায়, ফেব্রুয়ারির দুপুরে জমাটি খেলাধুলো। নিছক ব্যাট-বলের টক্করে যার গুরুত্ব বোঝা যাবে না। বছরখানেক আগে অসহায়, অসংলগ্ন দশায় হাসপাতালে বন্দি তরুণই ব্যাট হাতে মাত করে দিচ্ছেন। তবে এলোপাথাড়ি চালিয়ে খেলে নয়। ব্যাট-বলের নিখুঁত সংযোগে ঠান্ডা মাথায় রান এল ঝুড়ি ঝুড়ি। পাঁচ ওভারের ম্যাচে অনায়াসে ৫০ হাঁকালেন বারাসতের প্রণব।

বেহালার নীলাঞ্জনা বা ঢাকার মুক্তার ব্যাডমিন্টন-শৌর্যও অনেক কথা বলে গেল। জীবনের চোরাপথে ছিটকে যাওয়া নয়, আর পাঁচ জনের মতো বাঁচার ক্ষমতায় কম যান না মানসিক হাসপাতালের ওই তথাকথিত রোগিণীরাও। বুধবার দুপুরে কলকাতার পাভলভ মানসিক হাসপাতাল চত্বরে এমন নানা ভুল ধারণা ভেঙে খানখান হল। শীতের এই সময়ে সাধারণত হাসপাতালের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে পিকনিকের আমেজে কিছুটা মুক্তির আনন্দ পান মানসিক হাসপাতালের আবাসিকেরা। এ বার করোনার তৃতীয় ঢেউ ফিকে হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সে ঝুঁকি নেননি। তার বদলে মাথা খাটিয়ে এক স্পোর্টস আসরের আয়োজন করা হয়েছিল। তাতে অন্য ভূমিকায় দেখা মিলল পাভলভের আবাসিকদের।

ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাইকায়াট্রি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক সৃজিত ঘোষকে খেলার সঙ্গী হিসাবে পেয়ে ভারী খুশি পাভলভের খেলুড়েরা। সৃজিতবাবুর মতে, “যে পরিস্থিতিতে কেউ মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হন, তাতে অনেকেই চরম অবসাদের শিকার হন। খেলাধুলোর সুযোগে সেই যন্ত্রণারও উপশম হয়। এটাও চিকিৎসার অঙ্গ।” আবাসিকদের সঙ্গে ব্যাট করতে নেমে মৃদু বকুনিও খেয়েছেন সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়। একদা পাড়ার চৌকস ব্যাটার প্রদীপ দাস এসে ‘টিপস’ দিলেন, “স্ট্র্যাটেজি কই? সব বলে অত চালিয়ে খেললে হয়!” রত্নাবলী পরে বলছিলেন, “হাসপাতালে ডাক্তার-রোগী সম্পর্কে একটা ক্ষমতার আভাস থাকে। একসঙ্গে খেলতে নামলে সেই চেনা ছকগুলোও উল্টে যায়! এটা গুরুত্বপূর্ণ।” তাঁর কথায়, “মনে হচ্ছিল অনেকেই হারানো সামাজিক ভূমিকা ফিরে পেয়েছেন। খেলার আনন্দ, মজার থেকেও এটা বড়। মানসিক হাসপাতালে তো সবার গায়েই রোগী তকমা সেঁটে রয়েছে। সমাজও তাঁদের মানুষ বলে ভাবতে ভুলে যায়। খেলার এই আসর মানে তাঁদের হারানো সামাজিক ভূমিকারও উদ্‌যাপন।” মাঠে আগাগোড়া ছিলেন রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তা শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায় বা পাভলভের সুপার গণেশ প্রসাদ। সুপারের কথায়, “কোভিডের ভয়ে আবাসিকদের বাইরে পিকনিকের অনুমতি দেওয়া যায়নি। ওঁদের অনেকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। তবে ভিতরে যে ভাবে খেলার আসর বসেছে, তাতেও দারুণ আনন্দ হয়েছে।”

সব মিলিয়ে জনা ৮০ আবাসিক স্পোর্টসে শামিল হয়েছিলেন। সকালে কয়েক জন ছবি আঁকার আসরে বসেন। দুপুরে হাল্কা জলযোগ সেরে আবার মাঠে। ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন ছাড়াও ছিল বাজনার তালে ‘পাসিং দ্য লাভ’ বা ভালবাসা ছড়ানোর খেলা। হৃদয় আকৃতির একটি লাল বল হাতে হাতে ঘুরছিল প্রতিযোগীদের। ডাক্তারদের মতে, এর মধ্যেও আবাসিকদের রিফ্লেক্স বা চটজলদি পরস্পরকে সাড়া দেওয়া বা সংযোগের ক্ষমতা ঝালিয়ে নেওয়া হল। সব শেষে ভালমন্দ খেয়েদেয়ে আনন্দময় একটা দিনের অবসান। গোটা অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও আয়োজনের দায়িত্বে ছিল মানসিক রোগীদের ক্ষমতায়নের কাজে সক্রিয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তাঁদের আধিকারিক শুক্লা দাস বড়ুয়া বলছিলেন, “মানসিক হাসপাতালের আবাসিকেরাও অনেকে যে সমাজের আর পাঁচ জনের মতো মিলেমিশে থাকতে পারেন, তা-ও বোঝা যায় খেলার আসরেই। যাঁরা নানা খেলায় অংশ নিলেন, তাঁদের অনেকেই প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন। কেউ কেউ এখনও সামাজিক বাধায় মানসিক হাসপাতালে থাকতে বাধ্য হন। তাঁদের মূল স্রোতে ফেরানোরই তোড়জোড় চলছে।”

অন্য বিষয়গুলি:

Kolkata Hospital Mental Patient Cricket
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE