Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

থানায় তাণ্ডবের তোড়ে টেবিলের নীচে পুলিশ, কাঠগড়ায় ববি-সঙ্গী

নভেম্বর, ২০১১। শব্দবাজি ফাটিয়ে জগদ্ধাত্রী পুজোর শোভাযাত্রার অভিযোগে আটকদের ছাড়াতে ভবানীপুর থানায় থানা গেড়ে বসলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নভেম্বর, ২০১৪। আলিপুর থানায় তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের তাণ্ডব থেকে বাঁচতে থানার ভিতরেই টেবিলের তলায় সেঁধোলেন পুলিশকর্মীরা! শুক্রবার আলিপুর থানায় শাসক দলের তাণ্ডবের ঘটনায় অভিযোগের তির পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা প্রতাপ সাহার দিকে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৪৬
Share: Save:

নভেম্বর, ২০১১। শব্দবাজি ফাটিয়ে জগদ্ধাত্রী পুজোর শোভাযাত্রার অভিযোগে আটকদের ছাড়াতে ভবানীপুর থানায় থানা গেড়ে বসলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

নভেম্বর, ২০১৪। আলিপুর থানায় তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের তাণ্ডব থেকে বাঁচতে থানার ভিতরেই টেবিলের তলায় সেঁধোলেন পুলিশকর্মীরা!

শুক্রবার আলিপুর থানায় শাসক দলের তাণ্ডবের ঘটনায় অভিযোগের তির পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা প্রতাপ সাহার দিকে। সেই প্রতাপকে আড়াল করতে উঠেপড়ে লেগেছেন পুরমন্ত্রী। ঠিক যেমনটি করেছিলেন মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নার ক্ষেত্রে। গার্ডেনরিচে হরিমোহন ঘোষ কলেজের ভোট ঘিরে গোলমালে পুলিশ অফিসার তাপস চৌধুরীর মৃত্যুর পরে নিজের ঘনিষ্ঠ পুর-নেতা মুন্নাকে বাঁচাতে চেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি। এ দিন থানায় হামলা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তৃণমূলের রীতি মেনে ফিরহাদ প্রথমে বলেন, “অন্যায় করলে আইন আইনের পথে চলবে।” সেই সঙ্গেই তিনি যোগ করেন, “থানায় খোঁজ নিয়েছি। ওসি বলছেন, সে-রকম কিছু ঘটেনি।” প্রতাপ সাহা বলে কাউকে তিনি চেনেন না বলেই দাবি করেছেন ফিরহাদ।

মন্ত্রীর এই সার্টিফিকেটের পরে পুলিশ আর প্রতাপের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টাই করেনি। উল্টে পরিস্থিতি সামলাতে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা ঠিক করতে রাতে থানায় পুলিশকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রতাপই। সেই বৈঠক থেকে মন্ত্রীকে ফোনও করেন পুলিশকর্তারা।

সরকারি কাজ করতে গিয়ে শাসক দলের রোষে পুলিশের থরহরি কম্পমান হয়ে ওঠার অনেক ঘটনাই ইতিমধ্যে ঘটে গিয়েছে তৃণমূলের বাংলায়। শুক্রবার আলিপুর থানায় শাসক দলের ভৈরববাহিনীর হামলা অবশ্য সেই সব ঘটনাকেই ছাড়িয়ে গিয়েছে বলে অনেকের মত। তাঁদের কেউ কেউ বলছেন, ২০১১-য় পরিবর্তনের নয়া জমানায় মুখ্যমন্ত্রীর ভবানীপুর থানা অভিযান যদি হয় ভূমিকা, আলিপুর থানায় এ দিনের শাসক-তাণ্ডব যেন তার ক্লাইম্যাক্স!

পুলিশি সূত্রের খবর, শুধু তাণ্ডব নয়, থানায় আটক করে রাখা চার মহিলা-সহ ১৪ জন অভিযুক্তকেও ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে হামলাকারীরা। লালবাজার অবশ্য সরকারি ভাবে থানায় হামলা-মারধরের কথা স্বীকার করতে চায়নি। মুখে কুলুপ এঁটেছেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ। রাতে তিনি বলেন, “এ ব্যাপারে যা বলার যুগ্ম কমিশনার (সদর) বলবেন।” টেবিলের তলায় ঢুকে ফাইলের আড়ালে প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত পুলিশকর্মীর ক্যামেরাবন্দি ছবি দেখে রাজ্যবাসী যখন স্তম্ভিত, সেই সময়েই লালবাজারের এক পুলিশকর্তা এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, “হামলাকারীদের থেকে বাঁচার জন্য নয়, ক্যামেরায় ধরা না-পড়ার জন্যই উনি ও-ভাবে বসে ছিলেন।”

থানায় ঢুকে শাসক দলের এই হামলার ঘটনাটিকে লালবাজার কী চোখে দেখছে, পুলিশকর্তার এই ব্যাখ্যাই সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছে। পাঁচ জন ধরা পড়লেও এ দিনের হামলায় মূল অভিযুক্তদের কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। ঘটনাটিকে যতটা সম্ভব লঘু করে দেখাতে চেয়েছেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদও। তিনি বলেছেন, “সামান্য ঘটনা। কিছু মানুষ থানায় স্মারকলিপি দিতে গিয়েছিলেন।”

গত তিন বছরে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে শাসক দলের কর্মী-সমর্থকদের হাতে বারে বারেই নিগৃহীত হয়েছে পুলিশ। থানায় চড়াও হওয়ার ঘটনাও বিরল নয়। কিন্তু কলকাতা শহরে, খোদ মুখ্যমন্ত্রীর খাসতালুকেই (আলিপুর মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভা কেন্দ্র ভবানীপুরের অন্তর্গত) এমন ঘটনা কার্যত নজিরবিহীন বলে মনে করছেন প্রাক্তন পুলিশকর্তাদের একাংশ।

পুলিশেরই একাংশ বলছেন, থানায় হামলার ঘটনা এই প্রথম নয়। ২০০৮ সালে দক্ষিণ কলকাতার চারু মার্কেট থানায় চড়াও হয়েছিলেন তৃণমূলকর্মীরা। আবার ২০০৯ সালে পুলিশি হাজতে থাকা এক বন্দির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আলিপুর থানাতেই হামলা চালিয়েছিল তৃণমূল। তবে সেগুলো ছিল বাম জমানার ঘটনা। তৃণমূল তখন ছিল বিরোধী পক্ষ।

রাজ্যে পালাবদল ঘটিয়ে সেই তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে এই ধরনের ঘটনা যেন অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। শুক্রবারেই গরফা এলাকায় বেআইনি হকার তুলতে গিয়ে বেদম মার খেয়েছেন এক ট্রাফিক সার্জেন্ট। ইদানীং নানা কারণে প্রায় রোজই রাজ্যের কোথাও না কোথাও পুলিশের উপরে চড়াও হচ্ছেন শাসক দলের কর্মীরা। অনেক জায়গায় প্রকাশ্যেই মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছেন নেতারা! কোনও জায়গাতেই আইন আইনের পথে চলছে না।

গত পঞ্চায়েত ভোটের আগেই বোলপুরে এক জনসভায় পুলিশকে ‘বোম মারা’র নির্দেশ দিয়েছিলেন বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। সেই উক্তি নিয়ে শুরু হওয়া বিতর্ক আজও শেষ হয়নি। দুবরাজপুরে গোলমাল থামাতে গিয়ে বোমার আঘাতে মারা যান দুবরাজপুর টাউন থানার ওসি অমিত চক্রবর্তী। মাস দুয়েক আগে বোলপুর থানায় দলবল নিয়ে চড়াও হয়েছিলেন অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ বীরভূমের জেলা যুব তৃণমূল সভাপতি সুদীপ্ত ঘোষ।

পুলিশের উপরে হামলার ঘটনায় অনুব্রত-সুদীপ্তদের টিকি ছোঁয়ার সাহস দেখায়নি পুলিশ। কিন্তু পিঠ বাঁচাতে এমন লুকিয়ে পড়ার ঘটনাও আগে দেখা যায়নি। কলকাতা পুলিশের অনেকেই বলছেন, পরিবর্তনের জমানায় পুলিশের মেরুদণ্ড যে কার্যত গুঁড়িয়ে গিয়েছে, শুক্রবার আলিপুর থানার ঘটনা সেটাই প্রমাণ করেছে।

ঠিক কী ঘটেছে এ দিন?

পুলিশি সূত্রের খবর, আলিপুরে অতিরিক্ত জেলাশাসকের বাংলোর পিছনে ২০ কাঠার একটি সরকারি জমি আছে। সেখানে প্রশাসনিক কর্তাদের জন্য ‘ধনধান্য’ আবাসন গড়ার কথা। কয়েক দিন আগে পূর্ত দফতরের কর্মীরা ওই জমি মাপজোক করে আসেন। এ দিন সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ পাঁচিল তৈরির জন্য মাটি কাটার কাজ শুরু হচ্ছিল। সেই সময় ওই জমির পাশে থাকা বিধানচন্দ্র রায়ের নামাঙ্কিত একটি কলোনির বাসিন্দারা এসে কাজে বাধা দেন। ওই জমিতে শাসক দলের ঝান্ডাও লাগিয়ে দেন তাঁরা। সরকারি কাজের জন্য পূর্ত দফতরের কর্মীদের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশও মোতায়েন করা হয়েছিল। এ দিন ওই কাজে নিযুক্ত পূর্ত দফতরের এক কর্মী বলেন, “আগের দিন মাপজোকের সময় ওই ঝান্ডা ছিল না।”

পুলিশ জানায়, পূর্ত দফতরের কর্মীরা কাজে বাধা পেতেই আলিপুর থানা বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করে। দু’পক্ষের মধ্যে বচসা ও ধস্তাধস্তি শুরু হয়। পুলিশ ১৪ জনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পুলিশের পিছু পিছু ওই কলোনির বাসিন্দা এবং স্থানীয় তৃণমূলকর্মীদের একাংশও হাজির হন আলিপুর থানায়। ভিড় ঠেকাতে থানার গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ধাক্কা দিয়ে সেই গেট খুলে থানায় ঢুকে শুরু হয় পুলিশকে মারধর আর ভাঙচুর। আটক ব্যক্তিদের ছাড়িয়েও নিয়ে যায় হামলাকারীরা। হয় রাস্তা অবরোধও।

ওই কলোনির বাসিন্দারা অবশ্য বলছেন, তাঁরা কাজে বাধা দেননি। পূর্ত দফতরের কর্মীরাই নিয়ম ভেঙে জমি দখল করছিলেন। থানায় চড়াও হয়ে হামলার কথাও অস্বীকার করেছেন তাঁরা। কলোনি কমিটির কার্যনির্বাহী সভাপতি রবীন্দ্রকুমার মহান্তি বলেন, “পুলিশই কলোনির বাসিন্দাদের মারধর করেছে। রীতা পাসোয়ান নামে আহত এক মহিলাকে পুলিশ থানায় আটকে রেখেছিল। চিকিৎসাও করায়নি। তাঁকে ছাড়াতেই থানায় যাওয়া হয়েছিল।” রীতার অভিযোগ, ঘটনাস্থলে কোনও মহিলা পুলিশ ছিল না। ওসি-ই জোর করে তাঁদের গাড়িতে তুলেছিলেন। তবে লালবাজারের দাবি, মহিলা পুলিশ ছিল। লাঠি চালানোর অভিযোগও অস্বীকার করেছে পুলিশ।

লালবাজারের একাংশ বলছেন, থানায় ঢুকে অভিযুক্তকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার তৃণমূলি নজির তৈরি করেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীই। ২০১১ সালের নভেম্বরে হাজরা মোড়ে রাস্তা আটকে জগদ্ধাত্রী পুজোর শোভাযাত্রা ও শব্দবাজি ফাটানোর অভিযোগে কয়েক জন উদ্যোক্তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। তাঁদের ছাড়াতে থানায় চড়াও হন স্থানীয় তৃণমূলকর্মীরা। শেষে আটকদের ছাড়াতে গভীর রাতে ভবানীপুর থানায় হাজির হয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলিশের একাংশের অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই শেষ পর্যন্ত দুই অভিযুক্তকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল থানা।

সেটাই ছিল শুরু। পরে বইমেলার সময়ে মিলনমেলায় খোদ মুখ্যমন্ত্রীই ‘চাবকানো উচিত’ বলে ধমক দিয়েছিলেন পুলিশকর্মীকে। গার্ডেনরিচে পুলিশ অফিসার তাপস চৌধুরীর হত্যাকাণ্ডে অন্যতম মূল অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা ইকবাল (মুন্না) ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রকাশ্যে। বীরভূমের অনুব্রতকে আদালতে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন খোদ ডিজি। সর্বত্রই শাসক দলের চাপে কার্যত নতজানু পুলিশ।

এ দিন আলিপুর থানার ঘটনার পরেও পুলিশ কার্যত নতিস্বীকারই করেছে। হামলার ঘণ্টা তিনেক পরে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতাদের গ্রেফতারের দাবিতে আলিপুর থানায় বিক্ষোভ দেখায় কংগ্রেস। ডিসি (সাউথ) মুরলীধর শর্মা বলেন, “সরকারি কর্মীদের কাজে বাধা, হাঙ্গামা, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট এবং বেআইনি জমায়েতের অভিযোগে একটি মামলা রুজু করা হয়েছে গ্রেফতার করা হয়েছে পাঁচ জনকে।”

কিন্তু মূল অভিযুক্তদের ধরা হচ্ছে না কেন?

পুলিশের একাংশের বক্তব্য, ওই কলোনি কমিটির নেতা প্রতাপ সাহা পুরমন্ত্রী ফিরহাদের ঘনিষ্ঠ। কলোনি কমিটিও শাসক দলের দখলে। তাই তাঁদের গ্রেফতার করার সাহস দেখায়নি পুলিশ। প্রতাপকে বারবার ফোন করেও সাড়া মেলেনি। সন্ধ্যার পরে তাঁর ফোন বন্ধ হয়ে যায়।

পুলিশের খবর, হামলার খবর পেয়েই ডিসি (সাউথ) থানায় হাজির হন। দক্ষিণ বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার বুদ্ধদেব মুখোপাধ্যায় এবং আলিপুর থানার ওসি বুদ্ধদেব কুণ্ডুকে নিয়ে বৈঠক করেন তিনি। পরে থানায় ডেকে পাঠানো হয় কলোনি কমিটির সভাপতি প্রতাপ সাহা এবং কার্যনির্বাহী সভাপতি রবীন্দ্রকুমার মহান্তিকে। কী ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায়, সেই বিষয়েই পুলিশের সঙ্গে বৈঠকে বসেন প্রতাপ।

পরিস্থিতির সামাল দিতে আজ, শনিবার বৈঠক করার কথা পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের। এবং এর সুরাহা না-হওয়া পর্যন্ত ওই আবাসন তৈরির কাজ স্থগিত থাকবে।

এ দিনের ঘটনার পরে অনেকেই মনে করছেন, তিন বছর আগের নভেম্বরে ভবানীপুর থানায় হাজির হয়ে মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে যে-বার্তা দিয়েছিলেন, এ দিন আলিপুরের ঘটনা তারই প্রতিফলন। একই ভাবে মূল অভিযুক্তদের গ্রেফতারের বদলে মন্ত্রীর বৈঠকে ‘সুরাহা’র পথ খুঁজছে পুলিশ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE