বিপজ্জনক: অগ্নিকাণ্ডের পরেও গড়িয়াহাটের ফুটপাত ঢাকা সেই প্লাস্টিকেই। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
রাস্তাঘাট থেকে আলো, সৌন্দর্যায়ন থেকে সার্বিক পরিচ্ছন্নতা— পুর পরিষেবার নিরিখে উত্তর কলকাতার বিভিন্ন বরোর চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে দক্ষিণ কলকাতার প্রাণকেন্দ্র আট নম্বর বরো। কিন্তু তা সত্ত্বেও বেশ কিছু দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সেই সুনামের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন, গড়িয়াহাট মোড়।
২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে গড়িয়াহাট মোড়ের একটি পাঁচতলা বাড়িতে মাঝরাতে ভয়াবহ আগুন লাগে। সেই আগুন প্লাস্টিকের ছাউনি দেওয়া ফুটপাতের একাধিক দোকানকেও গ্রাস করে। এর পরেই কলকাতা পুরসভা ফুটপাতের দোকানে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু সেই ‘নিষেধাজ্ঞা’ যে কেবল খাতায়-কলমেই রয়েছে, আট নম্বর বরোয় খানিকটা ঘুরলেই তা পরিষ্কার! গড়িয়াহাটের এক বাসিন্দার অভিযোগ, ‘‘ফুটপাতের দোকানগুলি যে ভাবে প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা থাকে, তা রীতিমতো বিপজ্জনক।’’ অগ্নিকাণ্ডের পরে হকার সংগঠনগুলির সঙ্গে তৎকালীন মেয়র ফিরহাদ হাকিমের বৈঠকও হয়েছিল। প্রথম দিকে প্লাস্টিকের ব্যবহারে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ দেখা গেলেও এখন আবার যে কে সে-ই! ভবানীপুর বা হাজরার ফুটপাতেরও একই দশা। প্লাস্টিক-সমস্যার সমাধানের বদলে তা নিয়ে চাপান-উতোর চলছে পুরসভা ও হকারদের মধ্যে।
স্থানীয় বিধায়ক তথা ৮৫ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর দেবাশিস কুমার জানালেন, পুরসভা কিয়স্ক তৈরি করেছিল। কিন্তু হকারেরা তাতে ব্যবসা করতে রাজি হননি। হকারদের একটি সংগঠনের তরফে দেবরাজ ঘোষের পাল্টা দাবি, ‘‘গড়িয়াহাটে প্রায় আড়াই হাজার হকার রয়েছেন। অথচ, পুরসভা মাত্র ৩২ জনকে কিয়স্ক দিয়েছিল। বাকিরা তা হলে কী করবেন?’’
গড়িয়াহাট বাজারকে কেন্দ্র করে পার্কিংয়ের সমস্যাও জটিল আকার ধারণ করেছে। বড় রাস্তা থেকে যা পৌঁছেছে অলিগলিতেও। হিন্দুস্থান পার্কের বাসিন্দা অনুপ সেনগুপ্তের অভিযোগ, ‘‘গড়িয়াহাটে অনেকেই গাড়ি নিয়ে আসেন। যাঁদের একটি বড় অংশ পাড়ার গলিতে গাড়ি রেখে চলে যান। ফলে এলাকার বাসিন্দারা নিজেদের গাড়ি বার করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন। পুজোর সময়ে এই সমস্যা আরও জটিল হয়।’’
মোট ১১টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত আট নম্বর বরো পশ্চিমে কেওড়াতলা শ্মশান থেকে পূর্বে কাঁকুলিয়া রোড এবং উত্তরে এলগিন রোড থেকে দক্ষিণে সাদার্ন অ্যাভিনিউ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই বরোয় সবুজের সমাহার চোখে পড়লেও আমপানে প্রচুর গাছ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অবশিষ্ট থাকা গাছগুলির রক্ষণাবেক্ষণ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যা নিয়ে সরব বিরোধীরাও। ৮৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী রাজর্ষি লাহিড়ীর অভিযোগ, ‘‘গাছগুলি কংক্রিট দিয়ে ঘিরে দেওয়া হচ্ছে। ওরা শাখাপ্রশাখা মেলতে পারছে না।’’ বরোর বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে দেখা গেল, বহু গাছ তারের জঙ্গলে ঢাকা পড়েছে। কেব্ল সংযোগের ওই তারে পুরসভার বাতিস্তম্ভগুলিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ বিষয়ে উদ্যান বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত, বিদায়ী পুর প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য দেবাশিসবাবু জানান, তাঁর ওয়ার্ডে গাছসুমারি হয়েছে। অনেক গাছই বেশ প্রাচীন। তবু প্রতিটি গাছকেই বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। বাসিন্দাদের অবশ্য অভিযোগ, গত দেড় বছরে নতুন গাছ কিছু লাগানো হলেও সেগুলির বেশির ভাগই বাঁচেনি।
এই বরো এলাকার ৮৫ নম্বর ওয়ার্ড ভ্যাটমুক্ত। রাস্তাঘাট থেকে অলিগলি, সবই মোটের উপরে পরিচ্ছন্ন। ৮৮ নম্বর ওয়ার্ডে পরিচ্ছন্নতা চোখে পড়ার মতো। এমনকি, দৃশ্যদূষণ ঠেকাতে হোর্ডিং নিয়ন্ত্রণও করা হয়েছে। ওই ওয়ার্ডের বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর তথা সাংসদ মালা
রায় জানালেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য হোর্ডিং-ব্যানার লাগানো হলেও নির্দিষ্ট সময়ের পরে তা খুলে নেওয়া হয়। এই ওয়ার্ডেই কেওড়াতলা শ্মশান লাগোয়া মহীশূর উদ্যান পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র।
রবীন্দ্র সরোবর কেএমডিএ-র পরিচালনাধীন হলেও গেটের মুখে নোংরা ও রাস্তার খানাখন্দ নিয়ে ক্ষুব্ধ স্থানীয় বাসিন্দারা। এমনই এক জন সোমেন্দ্রমোহন ঘোষ বললেন, ‘‘শরৎ বসু রোড ও টালিগঞ্জের দিক থেকে সরোবরে ঢোকার মুখে নোংরা পড়ে থাকে। রাস্তাগুলিরও সংস্কার প্রয়োজন। সরোবরের আশপাশের যাত্রী-প্রতীক্ষালয়গুলিতে রাতে রীতিমতো মশারি টাঙিয়ে ফুটপাতবাসীরা ঘুমোন।’’ ৮৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিবেকানন্দ পার্ক ও ট্রায়াঙ্গুলার পার্ক নিয়েও স্থানীয় স্তরে অভিযোগ রয়েছে। তৃণমূল প্রার্থী সৌরভ বসুর অভিযোগ, বিভিন্ন পরিষেবার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে ওই ওয়ার্ড। প্রাক্তন কাউন্সিলর, বিজেপির তিস্তা বিশ্বাস মাসকয়েক আগে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। বিজেপি প্রার্থী রাজর্ষি লাহিড়ীর পাল্টা অভিযোগ, তিস্তা উন্নয়নের আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। বিরোধী দলে থাকায় পুরসভার সহযোগিতা মেলেনি।
এর উল্টো ছবি ৮৭ নম্বর ওয়ার্ডে। বিজেপি প্রার্থী অনুশ্রী চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘বিদায়ী পুর প্রতিনিধি সুব্রত ঘোষ অনেক কাজ করেছেন। সেটাই চালিয়ে যাব।’’ যদিও তৃণমূল প্রার্থী মনীষা বসু সাউয়ের দাবি, বরোর অন্যান্য ওয়ার্ডে যেমন উন্নয়ন হয়েছে, এই ওয়ার্ডে হয়নি।
আট নম্বর বরোয় অবশ্য বৃষ্টিতে জল জমার সমস্যা এবং বস্তির অনুন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ৬৯, ৭০, ৭২ ও ৮৫ নম্বর ওয়ার্ডে ভারী বৃষ্টি হলেই জল জমে যায়। ৯০ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী মৌসুমী ভট্টাচার্যের অভিযোগ, ‘‘দীর্ঘ দিন একই দল ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও জল জমার সমস্যা মেটেনি।’’ অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূল প্রার্থী চৈতালি চট্টোপাধ্যায় জানান, জল জমার সমস্যা মেটাতে বহু কাজ হয়েছে। সমস্যা আগের চেয়ে কম বলেও দাবি তাঁর।
৭২ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর সন্দীপরঞ্জন বক্সীর দাবি, ‘‘জল জমা ও পার্কিংয়ের সমস্যা ছাড়া এই বরোয় আর কোনও খামতি নেই।’’ এই বরোর কাঁকুলিয়া, বেলতলা ও বেকবাগানে একাধিক বড় বস্তি রয়েছে। সেখানে পানীয় জল সরবরাহের গতি কম। এ বিষয়ে ৬৯ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী দিলীপকুমার বসু বলেন, ‘‘জিতে এসে প্রথম কাজই হবে বস্তিবাসীদের পাশে দাঁড়ানো।’’ ৮৫ নম্বর ওয়ার্ডের বস্তি এলাকায় শৌচালয়ের উপরে ছোট ছোট জলাধার তৈরি করেছে পুরসভা। বিদায়ী পুর প্রতিনিধিদের বক্তব্য, বস্তিবাসীদের জীবনের মানোন্নয়ন ঘটানোর লক্ষ্যে কাজ চলছে। বিরোধীরা আবার বস্তি প্রসঙ্গে সিন্ডিকেট ও বেআইনি নির্মাণের প্রসঙ্গ তুলে আনছেন তাঁদের প্রচারে। তৃণমূলের দাবি, তাঁদের আমলেই বস্তির উন্নয়ন হয়েছে সব থেকে বেশি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy