প্রাক্তন মেয়র, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, শোভন চট্টোপাধ্যায় ও ফিরহাদ হাকিমকে (বর্তমানে পুর প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারপার্সন)। নিজস্ব চিত্র
কলকাতা পুর ইতিহাসের ২০০০ সাল থেকে ২০২১ সাল— এই দু’দশক এক সূত্রে বাঁধা পড়ল সোমবার, নারদা মামলার হাত ধরে। যেখানে তিন প্রাক্তন মেয়র, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, শোভন চট্টোপাধ্যায় ও ফিরহাদ হাকিমকে (বর্তমানে পুর প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারপার্সন) গ্রেফতার করল সিবিআই।
এই গ্রেফতারি নিয়ে চর্চা, রাজনৈতিক চাপানউতোর, বিতর্ক সবই থাকবে। কিন্তু পুরকর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, পুর ইতিহাসে ১৭ মে দিনটি ‘চিরস্থায়ী’ হয়ে থাকবে। কারণ, কলকাতা পুর আইন ১৯৮০ চালু হওয়ার পর থেকে এত বিতর্কিত দিন পুরসভার ক্ষেত্রে আর আসেনি। অবশ্য শুধু কলকাতা পুর আইন ১৯৮০-ই বা কেন, তার আগেও পুরসভার ক্ষেত্রে এমন ‘সন্ধিক্ষণ’ আসেনি বলেই জানাচ্ছেন পুরকর্তারা।
পুরসভার নথি জানাচ্ছে, সুব্রত মুখোপাধ্যায় ২০০০ সালের ১২ জুলাই মেয়র পদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাঁর সময়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল জলকর বসানো। যদিও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্মতি না থাকায় শেষ পর্যন্ত তিনি তা করতে পারেননি। এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘কিন্তু এখন জলসঙ্কট মেটানোর জন্য বারবার যে জলকরের প্রসঙ্গ উঠে আসে, তার সূত্রপাত কিন্তু সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের আমলেই হয়েছিল।’’ ২০০৫ সালে বামেরা পুরবোর্ড দখল করার পরে ২০১০ সালে ফের কলকাতা পুরবোর্ড তৃণমূলের দখলে আসে। এ বার মেয়র পদে বসেন শোভন চট্টোপাধ্যায়। তথ্য বলছে, ২০১০ সালের ১৬ই জুন শোভন মেয়র পদের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পুরকর্তাদের একাংশের বক্তব্য, পানীয় জলের প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে এই প্রাক্তন মেয়রের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এক পুর ইঞ্জিনিয়ারের কথায়, ‘‘আগে কত ফুট গভীরে পাইপ বসালে জল পাওয়া যেত, এখন কত ফুট গভীরে নামলে তবে জল পাওয়া যায়, পাইপের মাপ কত হবে— এমন ছোটখাটো বিষয়েও শোভন চট্টোপাধ্যায়ের স্পষ্ট ধারণা ছিল।’’
২০১৫ সালেও কলকাতা পুরবোর্ড দখল করে তৃণমূল। এ বারও মেয়র হন শোভন। ঘটনাচক্রে ২০১৫ সালের ১৮ মে, অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক ছ’বছর আগে মেয়র পদে ফের আসীন হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এই পর্বের মাঝামাঝি সময় থেকেই শোভনের সঙ্গে দলের একটা ‘টানাপড়েন’ চলতে থাকে। যার প্রভাব পুরসভার কাজের উপরেও পড়েছিল বলে জানাচ্ছেন পুরকর্তারা। এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘প্রথম বার যতটাই সংগঠিত ভাবে তিনি (শোভন চট্টোপাধ্যায়) পুরসভার কাজকর্ম পরিচালনা করেছিলেন, দ্বিতীয় বার ঠিক ততটাই অসংগঠিত হয়ে যায় সব কিছু।’’
শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতার নির্দেশে ২০১৮ সালের নভেম্বরে মেয়র পদ থেকে ইস্তফা দেন শোভন। তার আগে তিনি রাজ্য মন্ত্রিসভা থেকেও ইস্তফা দিয়েছিলেন। পুরসভার এই পর্বকে খুবই ‘টালমাটাল’ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন পুরকর্তারা। কারণ, শোভনের পরবর্তী মেয়র কে হবেন, তা নিয়ে কানাঘুষো শুরু হয়েছিল। অনেক নাম নিয়ে জল্পনা চললেও মমতার সিদ্ধান্ত ছিল পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে মেয়র করার। এক পুরকর্তা বলছেন, ‘‘ফিরহাদ হাকিমের ভূমিকা পুর প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে, তার একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। কারণ, বরো অফিসের কাজের দেখভাল করছিলেন তিনি। কাউন্সিলর, পুর আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকও করছিলেন।’’
ফিরহাদকে মেয়র পদে বসানোর পথ প্রশস্ত করতে বিধানসভায় বিলও পাশ করানো হয়। কারণ, এত দিনের পুর আইন অনুযায়ী, কলকাতা পুরসভার মেয়র পদে বসতে গেলে পুর এলাকার কাউন্সিলর হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু সংশোধিত পুর আইন অনুযায়ী, কেউ কাউন্সিলর না হয়েও মেয়র হতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে তাঁকে ছ’মাসের মধ্যে কোনও ওয়ার্ড থেকে জিতে আসতে হবে। বাস্তবে তেমনটাই হয়। ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর মেয়র পদে বসেন ফিরহাদ। জনসংযোগকে পুরসভার বৃত্তে আবদ্ধ না রেখে ‘টক টু মেয়র’-সহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে ফিরহাদ কার্যত তা বাড়ি-বাড়ি পৌঁছে দেন। সঙ্গে জোর দেন দরপত্র প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার উপরে। এর মধ্যে পুরবোর্ডের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় পুর প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারপার্সন হন ফিরহাদ। মাঝখানে নির্বাচনের জন্য অবশ্য সে পদ থেকে তাঁকে সরে যেতে হয়। এক পুরকর্তা বলছেন, ‘‘পুর পরিষেবা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য নির্বাচন মেটার পরেই ফিরহাদ হাকিমকে ফের পুর প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারপার্সন পদে নিয়োগ করেছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি, তাতে এই প্রাতিষ্ঠানিক অস্থিরতা কবে মিটবে বলা মুশকিল।’’
প্রথমে সকলের জামিন মঞ্জুর হয়েও রাতে জামিনে স্থগিতাদেশ-সহ সোমবার দিনভর যা টানাপড়েন চলল, তাতে আক্ষরিক অর্থেই ১৭ই মে কলকাতা পুর প্রশাসনের ইতিহাসে তো বটেই, রাজ্য রাজনীতিতেও চিরস্থায়ী জায়গা করে নিল বলে মত ওয়াকিবহাল মহলের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy