আলিপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। — ফাইল চিত্র।
ফুসফুস ও শ্বাসনালীতে গুরুতর সংক্রমণ নিয়ে আলিপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের ভেন্টিলেশনে ভর্তি রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রথমে বুদ্ধদেবকে ‘নন-ইনভেসিভ ভেন্টিলেশনে’ রাখা হয়েছিল কিন্তু রাতে তাঁকে ‘ভেন্টিলেশন’-এ দেওয়া হয়। দু’বছর আগেও একবার ওঁকে ভেন্টিলেশনে দিতে হয়েছিল দু’দিনের জন্য। কিন্তু তার পরে ওঁর কোভিড হয়েছে। ফলে ফুসফুসের জোর আরও কমেছে। গত দু’বছরে সিওপিডি-ও আরও বেড়েছে। বুদ্ধদেবের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা এক চিকিৎসক শনিবার গভীর রাতে বলেন, “আপাতত আজ রাতের লড়াইটা জিততে চাইছি। তার পর ধাপে ধাপে এগোবে প্রক্রিয়া। বুদ্ধদেববাবুর নিজে থেকে শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছিল। তাই ওঁকে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধ চলবে।” বুদ্ধদেবের ক্রিয়েটিনিন বেশি বলে জানিয়েছেন তাঁর চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা এক চিকিৎসক। তবে তাঁর প্রস্রাবের পরিমাণ স্বাভাবিক।
শনিবার দুপুরে যখন তাঁকে হাসপাতালে আনা হয় তখন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর শারীরিক অবস্থা যেমন ছিল, এখন তার চেয়ে খুব বেশি উন্নতি হয়নি। যদিও তাঁর সংক্রমণের মাত্রা দেখে চিকিৎসকেরা মনে করছেন, দীর্ঘ দিন তাঁদের তত্ত্বাবধানে থাকতে হতে পারে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে। চিকিৎসকদের সূত্রে জানা গিয়েছে, বুধবারই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন বুদ্ধদেব। শুক্রবার থেকে পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতেই স্যালাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছিল অ্যান্টিবায়োটিক। দীর্ঘ দিনের সিওপিডি-র রোগী বুদ্ধদেব শনিবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকেরা। পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, দুপুরের খাবার খাওয়ার পরেই শ্বাসকষ্টের সমস্যা বৃদ্ধি পায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর। তার পর তড়িঘড়ি বালিগঞ্জের পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়ি থেকে তাঁকে আলিপুরের ওই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে দিতে কলকাতা পুলিশ বালিগঞ্জ থেকে আলিপুরের ওই বেসরকারি হাসপাতাল পর্যন্ত ‘গ্রিন করিডর’ করার ব্যবস্থা করে। দ্রুত ‘ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে’ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় বুদ্ধদেবকে। দু’বছর আগে করোনা সংক্রমিত হয়ে এই একই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বুদ্ধদেব। হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়েছে, বুদ্ধদেবের চিকিৎসার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে একটি দল গঠন করা হয়েছে। ‘ক্রিটিক্যাল কেয়ার’ বিশেষজ্ঞের পাশাপাশি তাতে রয়েছেন কার্ডিয়োলজি, মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরাও।
যদিও হাসপাতালে যেতে বরাবরই অনীহা প্রকাশ করে থাকেন সিপিএমের এই বর্ষীয়ান নেতা। কিন্তু শনিবার পরিস্থিতি এতটাই জটিল আকার ধারণ করে যে, বুদ্ধদেব নিজে আর তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি করেননি বলে জানা গিয়েছে। শনিবার দুপুরের পরে বুদ্ধদেবকে দেখতে হাসপাতালে পৌঁছন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস, সিপিএম নেতা রবীন দেব, বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য প্রমুখ। সুস্থতা কামনা করে টুইট করেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। রাজ্যপাল জানান, বুদ্ধদেব দক্ষ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। তিনি বুদ্ধদেবের স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য এবং তাঁদের একমাত্র সন্তান সুচেতনের সঙ্গে দেখা করে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন।
গুরুতর অসুস্থ বুদ্ধদেব
চলতি সপ্তাহের শুরু থেকেই শারীরিক ভাবে ভাল ছিলেন না বুদ্ধদেব। বুধবার তাঁর নিউমোনিয়া ধরা পড়ে। ফুসফুসেও সংক্রমণ ছিল। শুক্রবার থেকে পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে স্যালাইনের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছিল তাঁকে। তখনও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়নি। বাড়িতেই ছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। যদিও তাঁকে নিয়মিত নজরদারির মধ্যে রাখছিলেন চিকিৎসক কৌশিক চক্রবর্তী। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় শনিবার। পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, শনিবার মধ্যাহ্নভোজের পর শ্বাসকষ্টের সমস্যা বাড়তে থাকে বুদ্ধদেবের। সেই সঙ্গে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রাও ক্রমশ কমতে থাকে। সূত্রের খবর, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা একটা সময় কমে হয়ে যায় ৬০ শতাংশের আশপাশে। বর্ষাকালে এমনিতেই সিওপিডি-র সমস্যা বৃদ্ধির সম্ভাবনা বহু গুণ বৃদ্ধি পায়। সব দিক বিবেচনা করে ঝুঁকি না নিয়ে বুদ্ধদেবকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকেরা। সেই অনুযায়ী আলিপুরের ওই বেসরকারি হাসপাতালে শুরু হয় প্রস্তুতি। তৈরি রাখা হয় আইসিইউ। হাসপাতাল থেকে জানানো হয়, বুদ্ধদেবের চিকিৎসার জন্য তৈরি করা হয়েছে একটি মেডিক্যাল বোর্ড। তাতে রয়েছেন, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কৌশিক চক্রবর্তী, ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ সৌতিক পাণ্ডা, ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ সুস্মিতা দেবনাথ, ইন্টারভেনশনাল কার্ডিয়োলজিস্ট সরোজ মণ্ডল, ইন্টারনাল মেডিসিন এবং পালমোনোলজিস্ট অঙ্কন বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্টারনাল মেডিসিন এবং ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ ধ্রুব ভট্টাচার্য, অ্যানাস্থেসিওলজিস্ট আশিস পাত্র, জেনারেল ফিজিশিয়ান সপ্তর্ষি বসু এবং সোমনাথ মাইতি। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, এখন আগের চেয়ে খানিকটা ভাল আছেন বুদ্ধদেব। তবে শ্বাসনালী এবং ফুসফুসে সংক্রমণ যে আকার ধারণ করেছে তাতে তাঁকে দীর্ঘ দিন চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে চলতে হতে পারে বলে জানা গিয়েছে। তাঁর ‘বাইল্যাটারাল নিউমোনিয়া’ হয়েছে। শরীরে ‘ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ব্যাক্টেরিয়া’ পাওয়া গিয়েছে। তা থেকেই নিউমোনিয়া। তবে, এখন জ্বর নেই। যদিও, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর দুটো ফুসফুসে সংক্রমণ আছে। বুদ্ধদেবের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা অনেকটাই বেড়েছে। যদিও শরীরে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা কমতে সময় নিচ্ছে। ফলে তিনি ‘বিপন্মুক্ত’ নন। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, এমনিতে খানিকটা আচ্ছন্ন অবস্থায় রয়েছেন তিনি। তবে নাম ধরে ডাকলে সাড়া দিচ্ছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। হাসপাতালে তাঁর একাধিক পরীক্ষানিরীক্ষা করানো হয়েছে। কিছু রিপোর্ট এখনও হাতে পাওয়া যায়নি। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, আগামী ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় বুদ্ধদেবকে ‘ইনভেসিভ ভেন্টিলেশন’-এ দেওয়া হয়। হাসপাতাল সূত্রে খবর, ভর্তি করার ছ’ঘণ্টা পরেও অবস্থার তেমন উন্নতি না হওয়ায় তাঁকে ভেন্টিলেশনে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাঁর রক্তচাপ কমের দিকে ছিল। চিকিৎসকদের আশা, আগামী ২ থেকে ৩ ঘণ্টায় তাঁর শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে পারে। হাসপাতাল সূত্রে খবর, বুদ্ধদেবের ‘সিআরপি সি- রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন’ ৩২৮। অর্থাৎ সংক্রমণ অনেকটাই।
দু’বছর আগেও একবার বুদ্ধদেবকে ভেন্টিলেশনে দিতে হয়েছিল দু’দিনের জন্য। তার পরে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর কোভিড হয়েছে। ফলে ফুসফুসের জোর আরও কমেছে। গত দু’বছরে সিওপিডি-ও আরও বেড়েছে।
গ্রিন করিডর করে হাসপাতালে
বুদ্ধদেবকে নিয়ে ‘ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যাম্বুল্যান্স’ রওনা দেয় আলিপুরের পথে। গোটা পথটি গ্রিন করিডর করে দিয়েছিল পুলিশ। ফলে দ্রুত অ্যাম্বুল্যান্স এজেসি বোস রোড উড়ালপুল ধরে পৌঁছে যায় আলিপুর। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল ৪টে ২২ মিনিট। হাসপাতালের মূল ফটক দিয়ে বুদ্ধদেবকে নিয়ে ঢোকে অ্যাম্বুল্যান্স। অ্যাম্বুল্যান্সেই তাঁকে সি-প্যাপ সাপোর্ট দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধি করিয়ে কার্বন ডাই অক্সাইড কমানো হয়। তড়িঘড়ি তাঁকে স্ট্রেচারে শুইয়ে হাসপাতালের ভিতরে নিয়ে চলে যান চিকিৎসকেরা। মুখে লাগানো হয় ‘হাই ফ্লো নেজাল অক্সিজেন’ সাপোর্ট। অ্যাম্বুল্যান্সের পিছন পিছন হাসপাতালে পৌঁছন স্ত্রী মীরা। তার কিছু ক্ষণ আগেই অবশ্য হলুদ ট্যাক্সিতে হাসপাতালে পৌঁছন বুদ্ধদেব-মীরার একমাত্র সন্তান সুচেতন।
হাসপাতালে রাজ্যপাল
বিকেল সওয়া ৪টের সামান্য পরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স ঢোকে আলিপুরের বেসরকারি হাসপাতালে। তার কিছু ক্ষণের মধ্যেই রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে দেখতে হাসপাতালে পৌঁছে যান রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। সংস্কৃত কলেজে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর অসুস্থতার খবর পান তিনি। সেখানেই সিদ্ধান্ত নেন, তিনি যাবেন বুদ্ধদেবকে দেখতে। সেই মতো রাজ্যপালের কনভয় ছোটে আলিপুরের উদ্দেশে। হাসপাতালে পৌঁছে তিনি কথা বলেন চিকিৎসকদের সঙ্গে। বুদ্ধদেব-জায়া মীরা এবং সুচেতনের সঙ্গে কথা বলেন। রাজ্যপাল তাঁদের আশ্বস্ত করেন, দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন বুদ্ধদেব। বাইরে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলেন রাজ্যপাল। সেখানে তিনি রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন। জানান, বুদ্ধদেব অত্যন্ত দক্ষ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। খুব দ্রুত তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। বুদ্ধদেবের অসুস্থতার খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন সিপিএম নেতা রবীন দেব। রাজ্যপাল যখন মীরা এবং সুচেতনের সঙ্গে কথা বলছেন, তখন পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন রবীন। সিপিএম সূত্রে খবর, রাত ১২টা ৪০ নাগাদ দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের সঙ্গে কথা হয় মেডিক্যাল বোর্ডের এক চিকিৎসকের। সেলিমকে জানানো হয়েছে, ফুসফুসে সংক্রমণের জন্যই বুদ্ধদেবকে এই ধরনের ভেন্টিলেটর সাপোর্ট দিতে হয়েছে। রবিবার সকাল ১১টার পর পরিস্থিতি দেখে পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে ভাববে মেডিক্যাল বোর্ড। এমনটাই জানিয়েছেন সেলিম।
বুদ্ধদেবের খোঁজ নিতে হাসপাতালে আসেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য, সিপিএমের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রেরা। বিজেপি সূত্রে খবর, রবিবার দুপুরে বুদ্ধদেবের খোঁজ নিতে হাসপাতালে যেতে পারেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। বুদ্ধদেবের সুস্থতা কামনা করেন কলকাতা সফররত কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর। শুভেন্দু অধিকারী, তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ টুইটে তাঁর সুস্থতা কামনা করেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy