Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪

শ্রাবণের অসাধ্য তুমি

কিন্তু আসবে। আসে। কারণ তিনি আছেন যে! তিনি যে মেলাবেন, মেলাবেনই! তাই শ্রাবণের শেষ সপ্তাহে ঢুকে, এই বিরহের দিনে তিনি দিয়ে গেলেন অসংখ্য প্রার্থনার বৃষ্টি! 

ছত্রধর: তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই স্কুলের পথে। বৃহস্পতিবার, মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

ছত্রধর: তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই স্কুলের পথে। বৃহস্পতিবার, মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী (লেখক)
শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৯ ০১:৩৫
Share: Save:

এ বারের বর্ষা ছিল কালি ফুরিয়ে আসা রিফিলের মতো। কিছুতেই একটা গোটা বাক্য লেখা যাচ্ছিল না তাকে দিয়ে। ছাড়া ছাড়া কয়েক ফোঁটা জল, শুকনো ফুটপাত, হারিয়ে যাওয়া বকুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল চারিপাশে। তার সঙ্গে মন খারাপ, গরম আর চাপা রাগ বাড়ছিল বিপদসীমার দিকে। সবারই মনে হচ্ছিল, তবে কি এ বার আর আসবে না সে? তবে কি এ বার শহরের পথ ভুলে গেল মৌসুমী বায়ু!

কিন্তু আসবে। আসে। কারণ তিনি আছেন যে! তিনি যে মেলাবেন, মেলাবেনই! তাই শ্রাবণের শেষ সপ্তাহে ঢুকে, এই বিরহের দিনে তিনি দিয়ে গেলেন অসংখ্য প্রার্থনার বৃষ্টি!

আজ বাইশে শ্রাবণ! তাঁর চলে যাওয়ার দিন। আবার আজ আমাদের কাছে বৃষ্টি ফেরত পাওয়ার দিনও!

আজ শহর ফিরে পেল অনেক কিছু! ফিরে পেল সেই সব, যা কেবল বৃষ্টিই দিতে পারে! আজ তাই ফিরে পেলাম পায়রার গলার রঙের আকাশ। পেলাম, লাল-হলুদ-নীল-সবুজ রেনকোট পরা কচিকাঁচাদের সারি। প্লাস্টিক ঢাকা খবরের কাগজওয়ালা। রেন জ্যাকেটে মোড়া বাইকচালক। পেলাম বারান্দা থেকে হাত বাড়িয়ে বহু দিন পরে জলের ফোঁটা ছুঁতে চাওয়া একলা দাদু। জমা জলে পা ডুবিয়ে আনন্দে লাফাতে লাফাতে চলা ছেঁড়া জামার বালক! আর পেলাম সেই সব গাছেদের, যারা একটা রুক্ষ শীত পার করে, বিষণ্ণ গ্রীষ্মে একা দাঁড়িয়েছিল শুধু মাত্র একদিন বৃষ্টি আসবে বলে!

আর সে এল এমন এক জনের হাত ধরে, যাঁর গানে-কবিতায় মিলেমিশে আছে এই ঋতু। যিনি না থাকলে বাঙালির কাছে বর্ষার এই মাধুর্য এমন ভাবে থাকত না! বাঙালি বুঝত না ধূসর তুলোর মতো মেঘ দেখলে তার হৃদয় কেন এমন ময়ূরের মতো নাচে!

সেই শিলাইদহের বোটের উপর থেকে, মংপুর পাহাড়ি কুয়াশার থেকে, শান্তিনিকেতনের গেরুয়া পথের শেষ প্রান্তে আবছা হয়ে আসা জল-ওড়নার থেকে বা জোড়াসাঁকোর খড়খড়ির আড়াল থেকে দেখা বিভিন্ন বয়সের বৃষ্টি যে আসলে তাঁর বহু পুরনো বন্ধু! তাই তো তিনি সেই বৃষ্টির সঙ্গে, তাঁর বন্ধুর সঙ্গে, আমাদের নানা ভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। চেয়েছেন তাঁর মতো আমাদের সঙ্গেও যেন বন্ধুত্ব হয় এই নরম জলভার ঋতুটির!

তাই আজ তাঁর যাওয়ার দিনে, চির বিদায়ের দিনে বন্ধুকে দেখতে আর এক বন্ধু যে আসবেই, সে তো জানা কথা।

আর তাই বর্ষার আগমনে প্রথম পূর্ণ বৃষ্টির স্বাদ পেল আমাদের শহর। পাশের বাড়ির থেকে ভেসে এল, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’। ভেসে এল, ‘কখন বাদল-ছোঁওয়া লেগে/ মাঠে মাঠে ঢাকে মাটি সবুজ মেঘে মেঘে।’

অফিস আসার পথে শুনলাম গ্রিল ঘেরা বারন্দায় সামান্য অশক্ত গলায় দিদিমা গাইছেন— ‘আবার শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে, মেঘ-আঁচলে নিলে ঘিরে।’

দু’মুহূর্ত দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। ভাব করলাম, বৃষ্টি বাড়ল তো তাই দাঁড়ালাম ছাউনির তলায়! আসলে তা নয়। আমি দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে শুনলাম গান! আর মনে পড়ে গেল বালকবেলায় আমাদের সেই ছোট্ট মফস্‌সলে, এমন বৃষ্টির দিনে অল্প আলোর আবছা রান্নাঘরে খিচুড়ি রান্নার মাঝে মা কেমন নিচু স্বরে গাইতেন, ‘ঝরো ঝরো ধারায় মাতি বাজে আমার আঁধার রাতি, বাজে আমার শিরে শিরে।’

বাইশে শ্রাবণে এ বার বর্ষা এল আমাদের শহরে। এই লেখা যখন লিখছি, তখন সামান্য রোদও উঠল। আবার কিছু পরে ডুবেও গেল তা মেঘের তলায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম বহু দিন পরে বৃষ্টি পেয়ে মানুষের হাসিখুশি মুখ! দেখলাম নানা মনখারাপে ডুবে থাকা শহরটা যেন আজ রেনি ডে-র ছুটি নিয়েছে! আর বুঝলাম, না, তিনি যাননি! তাঁর নশ্বর দেহ এই জগতে মিলিয়ে গেলেও মনে মনে, গানে গানে, বর্ষায় বর্ষায় তিনি আছেন! কোনও বাইশে শ্রাবণের সাধ্য নেই রবি ঠাকুরকে আমাদের থেকে সরিয়ে নেওয়ার!

অন্য বিষয়গুলি:

Weather Monsoon Rain
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy