অসহায়: পেটের ক্ষত ভোগাচ্ছে এখনও। ওয়াকার নিয়েও বেশি ক্ষণ হাঁটতে পারেন না নারায়ণ। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।
বেঁচে যে আছি, এটাই বড় কথা!
বাঁশের ভারা ভেঙে প্রায় ৭০ ফুট উঁচু থেকে নীচে পড়েছিলাম। পেট ফেটে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। বাঁ পা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। লোহার রড ঢুকিয়ে পা জুড়েছিলেন চিকিৎসকেরা। পেটের অর্ধেক জুড়ে থাকা সেলাই এখনও ভোগায়। কাজ তো করতে পারিই না, ওয়াকার ধরে সামান্য হাঁটাহাঁটি করলেও কষ্ট হয়। যাঁদের হয়ে কাজ করতে উঠেছিলাম, তাঁরা দেখতে আসেন না। তাই বাড়ির গায়ে ভারা বাঁধা দেখলেই ভয় হয়। মনে হয়, সেখানেও নিরাপত্তার বন্দোবস্ত ছাড়া কোনও এক শ্রমিককে তুলে দেওয়া হবে। কপালজোরে নেমে আসতে পারলে ভাল। আর কোনও ভাবে হাত ফস্কালে হয় মৃত্যু, নয়তো আমার মতো পঙ্গু হয়ে পড়ে থাকা।
কিন্তু একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও হুঁশ ফেরে না কর্তাদের। মাথায় হেলমেট, গায়ে রঙিন জ্যাকেট, কোমরে দড়ি বেঁধে কাজ করতে ওঠার নিয়ম থাকলেও কোথাও যে তা মানা হয় না, তা তাঁরা খোঁজই রাখেন না। নির্মাণস্থলে মেলে না সামান্য শুশ্রূষাও। পুলিশ শুধু অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা বা দুর্ঘটনার অভিযোগ দায়ের করে। অভিযোগ চাপা পড়ে যায়, ফের কাজের বরাত পেয়ে যায় সংশ্লিষ্ট ঠিকা সংস্থা। আমি কলকাতার ভোটার বলে জানি, ভোট দিয়েও এই পরিস্থিতির বদল হয় না। দিনপ্রতি ৪০০ টাকায় কাজে গিয়ে শ্রমিকদের প্রতিবাদ করারও সাহস থাকে না।
আমার বয়স ৫৯। বড় মেয়ে বিবাহিত। ছোট মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে আগে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে ভাড়ার ঘরে থাকতাম। দুর্ঘটনার পরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার পিয়ালি এলাকায় বড় মেয়ের শ্বশুরবাড়ির কাছেই ভাড়ায় থাকি। একটি ঠিকা সংস্থার হয়ে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে রাজ্য সরকারের মৎস্য সমবায় সংস্থা ‘বেনফিশ’-এর পঞ্চসায়র চকগড়িয়া বহুতলের প্রায় ৭০ ফুট উঁচু জলাধার সংস্কার করতে উঠেছিলাম। সঙ্গে ছিল সোমনাথ দাস নামে আর এক শ্রমিক। নিরাপত্তার জন্য কিছুই ছিল না আমাদের সঙ্গে। সোমনাথ বাঁশের ভারায় আমার থেকে উপরে দাঁড়িয়ে কাজ করছিল। হঠাৎ বাঁশ ভেঙে ও আমার উপরে এসে পড়ে। দু’জনে গিয়ে পড়লাম মাটিতে!
যেটুকু মনে আছে, শরীরের নীচের অংশ নাড়াতে পারছিলাম না। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল আশপাশ। জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে। ২৭ দিন থাকার পরে ছুটি হয়। শুনি, সোমনাথ বেঁচে নেই। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, আমার পেট ফেটে গিয়েছিল। পায়ে লোহার রড ঢোকাতে হয়েছে। রাতে ঘুম আসে না সেলাইয়ের জায়গার ব্যথায়।
কলকাতায় থাকা-খাওয়ার খরচ সামলাতে পারছিলাম না। ছোট মেয়ে ঝুমা কলেজে পড়ত। তাকেও পড়া ছাড়তে হল। কোনও মতে একটা কাজ পেয়েছে। সংসার আর আমার ওষুধের খরচ— এখন চলে ওর আয়েই।
আমার মতো শ্রমিকদের বলতে চাই, নিরাপত্তা নিয়ে নিজেরা ভাবুন। জনপ্রতিনিধিদের বলতে চাই, ভোট-রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে মানুষের জীবনের মূল্য দিন। নিয়ম তৈরি করলে তা পালন হচ্ছে কি না, সেটা দেখুন।
উঁচু থেকে পড়ে আহত শ্রমিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy