কাঠের এই খুপরি ঘরগুলিই (চিহ্নিত) বানিয়ে দেওয়া হয়েছে চড়াইদের জন্য। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়
পুরনো বাড়ির জায়গা নিচ্ছে একের পর এক বহুতল। সে সব বহুতলে ঘুলঘুলি বা কুলুঙ্গির কোনও স্থান নেই। আর তার জেরেই শহরে ক্রমশ ঠাঁইহারা হয়েছে চড়াই পাখিরা। বাসা বাঁধার বিকল্প জায়গা খুঁজে এখন অস্তিত্ব বাঁচানোর লড়াইয়ে ব্যস্ত তারা।
এই চড়াইদের ঠাঁই দিতেই বরাহনগর-কামারহাটি যৌথ জলপ্রকল্প এলাকায় তৈরি করা হয়েছে কাঠের খুপরি ঘর। রোজ ভোরে সেখান থেকে বেরিয়ে সারাদিন প্রকল্পের জঙ্গলে ঘুরে সন্ধ্যায় শান্তির আশ্রয়ে ফিরছে চড়াইয়ের দল।
দক্ষিণেশ্বরের আর এন টেগোর রোডের ধারে প্রায় ৩০ একর জমিতে রয়েছে এই জলপ্রকল্প। এর মধ্যে ২৫ একর জুড়ে রয়েছে জলাশয়। বাকি অংশে রয়েছে ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ও ৩৫ রকমের গাছে ঘেরা জঙ্গল। প্রকল্পের এক কর্মী কাজল পাল জানান, দীর্ঘদিন ধরেই ওই জায়গায় নানা প্রজাতির পাখি ও প্রাণীর আনাগোনা রয়েছে। তার মধ্যে ছিল শহর থেকে হারিয়ে যেতে বসা চড়াই পাখিও। বিষয়টি নজরে এসেছিল স্থানীয় পরিবেশকর্মীদেরও। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেই চড়াই পাখির বাসা বানানোর পরিকল্পনা করেন জলপ্রকল্পের কর্মীরা। সেই মতো ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, অফিস-সহ বেশ কয়েকটি ভবনের দেওয়ালে বানিয়ে দেওয়া হয়েছে তিন ফুট বাই এক ফুটের কাঠের বাক্স। ঢোকা-বেরোনোর জন্য বাক্সের গায়ে রয়েছে একাধিক ফুটো।
কর্মীরা জানান, ওই ফুটো দিয়ে ভিতরে ঢুকে ঘাস জাতীয় জিনিস দিয়ে বাসা বানায় চড়াইয়েরা। এই মুহূর্তে ১৪টি বাক্স রয়েছে ওই জলপ্রকল্পে। মাঝেমধ্যে বাক্সগুলি খুলে ভিতরের শুকনো ঘাস সাফ করেও দেওয়া হয়। ২০১২ সালে প্রথম এই ধরনের বাক্স বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে বাক্সের সংখ্যা বেড়েছে। জলপ্রকল্পের কর্তা ও কর্মীরা জানাচ্ছেন, এলাকায় রয়েছে অসংখ্য কাঠবেড়ালিও। চড়াইয়ের সঙ্গে তারাও ইদানীং খুপরি ঘরের দাবিদার হয়ে উঠেছে। ওই প্রকল্পের সভাপতি তথা বরাহনগর পুরসভার কাউন্সিলর অঞ্জন পাল বলেন, ‘‘হারিয়ে যেতে বসা কিছু পাখি ও প্রাণী রয়েছে জলপ্রকল্পের জঙ্গলে এবং জলাশয়ে। তাই ওদের সংরক্ষণ করার জন্য চেষ্টা করছি মাত্র। চড়াইয়ের বাসা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।’’
জলপ্রকল্পে চড়াই পাখি সংরক্ষণে সহযোগিতা করা এক পরিবেশ কর্মী চন্দন গোস্বামী জানান, শুধু বাক্স বানিয়েই তাঁদের কাজ শেষ হয়নি। ক’টি পাখি সেখানে ডিম পাড়ছে, ক’টি ছানা জন্মাচ্ছে, সে বিষয়ে প্রতি বছরই সমীক্ষা করা হয়। জীববিজ্ঞানী রতনলাল ব্রহ্মচারী জলপ্রকল্পে এসে সেখানকার জীববৈচিত্র ও চড়াই পাখি সংরক্ষণের বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে গিয়েছিলেন। চন্দনবাবু বলেন, ‘‘কর্তৃপক্ষকে বলেছি, কয়েকটি কাচের বাসা যদি বানিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে খুবই ভাল হবে। কারণ অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ুয়ারা আসেন চড়াই সংরক্ষণের বিষয়টি দেখতে।’’
জ়ুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার প্রাক্তন যুগ্ম-অধিকর্তা সুজিত চক্রবর্তী এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, ‘‘খাবার মিলছে না, ডিম পাড়ার জায়গাও কমে গিয়েছে— এই সবের জেরে আজ শহরে চড়াইয়ের সংখ্যাও ব্যাপক ভাবে কমে গিয়েছে। আগে বাড়ির ঠাকুরঘরের সিংহাসনের পিছনে ঘুপচি জায়গাতেও চড়াই বাসা বাঁধত।’’ তিনি জানান, মূলত ঘুপচি জায়গাই পছন্দ চড়াইয়ের। ঘুলঘুলি কিংবা কুলুঙ্গিতে ঘাস জাতীয় জিনিস দিয়ে বাসা তৈরি করে ডিম পাড়ত চড়াই পাখি। সারা দিন দোকান-বাড়ি-উঠোনে ছড়িয়ে দেওয়া চাল, গম, ধান বা আশপাশের গাছপালা থেকে ছোট ছোট পোকামাকড় খেয়ে জীবনযাপন করতেই অভ্যস্ত চড়াই পাখি। জলপ্রকল্পে সেই স্বাভাবিক পরিবেশই ফিরে পেয়ে চড়াইয়েরা।
হুগলির শ্রীরামপুর কলেজ চত্বরেও পড়ুয়ারা তৈরি করেছেন চড়াইয়ের জন্য এমন বাসা। রাজ্যের বায়ো-ডাইভার্সিটি বোর্ডের রিসার্চ অফিসার অনির্বাণ রায়ের কথায়, ‘‘নতুন প্রজন্মের মধ্যে যে এই সব পাখি সংরক্ষণের একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে, সেটা খুব ভাল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy