প্রতিমাতেও থাকছে অভিনবত্ব। ফাইল ছবি
‘ছপাক’ করে মুখে পড়েছে তরলটা। পরক্ষণেই নেমে আসছে কপাল-গাল বেয়ে। পুড়ছে চামড়া, গলছে চোখ-নাক। সঙ্গে তীব্র দহনজ্বালা। তার পরে? শুধুই লড়াই, লড়াই আর লড়াই।
এ বার পুজোয় অ্যাসিড হামলায় আক্রান্তদের সেই লড়াইকেই কুর্নিশ জানাচ্ছে সন্তোষপুর অ্যাভিনিউ সাউথ ক্লাব। তাদের দুর্গা দুই মেয়ের রক্ষাকর্ত্রী, আর অ্যাসিড হামলাকারীরাই সমাজের অসুর। পুজোর থিম ‘লক্ষ্মী’।
২০২০ সালের ‘ছপাক’ সিনেমা যে অ্যাসিড আক্রান্তের কথা বলে, তিনিও লক্ষ্মী। দিল্লির লক্ষ্মী আগরওয়াল। পর্দায় যাঁকে মালতী নামে ফুটিয়ে তোলেন দীপিকা পাড়ুকোন।
সন্তোষপুরের ওই পুজো কমিটির সম্পাদক মৈনাক ঘোষ বলছেন, ‘‘অ্যাসিড আক্রান্তদের লড়াই, যন্ত্রণা, জীবনবোধের কথাই এই থিমে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। বাড়ির মেয়েরা তো আমাদের লক্ষ্মী। তাই শুধু অ্যাসিড হামলা নয়, পণপ্রথা-সহ কোনও অত্যাচারই যেন তাঁদের সইতে না হয়। তার জন্য দরকার মানসিকতার পরিবর্তন। সেই বার্তাই ছড়িয়ে দিতে চাইছি।” পুজোর পাঁচ দিন অ্যাসিড আক্রান্তদের মণ্ডপে নিয়ে আসার ভাবনাও রয়েছে পুজোকর্তাদের।
সম্প্রতি প্রকাশিত ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড বুরো (এনসিআরবি)-র তথ্য বলছে, গত বছর রাজ্যে অ্যাসিড-হানার ঘটনা ঘটেছে ৩০টি। এমন ঘটনা বন্ধে প্রথমে সমাজের মানসিকতার বদল দরকার বলে মানছেন অ্যাসিড-আক্রান্ত সঞ্চয়িতা যাদব। ওই থিম-ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েও তাঁর প্রশ্ন, ‘‘পুজোর ক’টা দিন এমন থিম করে কি সেই বদল আনা সম্ভব?’’
সম্পর্ক থেকে বেরোতে চেয়েছিলেন দমদমের সঞ্চয়িতা। ২০১৪ সালে তাঁর প্রেমিকের রাগ অ্যাসিড হয়ে আছড়ে পড়ে তাঁর মুখে। সে অবশ্য এখন জেলে। ‘‘তবে সব হামলাকারীর তো শাস্তি হচ্ছে না। আরও কড়া আইন দরকার। ফাঁক আছে বলেই বার বার ঘটছে”— বলছেন যুদ্ধজয়ী কন্যা। জীবন বদলে যাওয়ার পরের লড়াইয়ে সব সময়ে পাশে পেয়েছেন মা ও স্বামীকে। সঞ্চয়িতার কথায়, ‘‘সবাই লড়াই চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন না। অনেকের বাড়ি থেকেও সহযোগিতা করে না।”
২০১৪ সালে স্বামীর প্রথম পক্ষের স্ত্রীর ছোড়া অ্যাসিডে ঝলসে গিয়েছিল রাজারহাটের ঊষা নস্করের মুখ-চোখ। হারিয়েছেন দৃষ্টিশক্তিও। পুজোয় অ্যাসিড আক্রান্তরাই থিম, এ কথা শুনে তাঁর গলায় দলা পাকিয়ে ওঠে যন্ত্রণা— ‘‘আর কিছু ভাল লাগে না। প্রথম স্ত্রীর কথা লুকিয়ে স্বামী কেন ঠকাল? কেন আমার মতো একটা মেয়ের এত বড় সর্বনাশ করা হল?”
হামলার সেই মুহূর্ত কী ভাবে এক নিমেষে বদলে দেয় সঞ্চয়িতা-ঊষাদের জীবন, সেই গল্পই মণ্ডপে তুলে ধরে বার্তা দিতে চান শিল্পী পাপাই সাঁতরা। তিনি জানান, হামলার পরে কী ভাবে পাল্টে যায় আক্রান্তদের জীবন, এক মুহূর্তে সমস্ত স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে— তা-ই দেখানো হবে মণ্ডপে। অ্যাসিডে পুড়ে যাওয়ার আগে ও পরে আক্রান্তদের দুই জীবনের ছবি থাকবে মণ্ডপে। পাপাই বলেন, ‘‘অ্যাসিড হানার আগের ছবিগুলি হবে হাতে আঁকা। আর হামলার পরের ছবিগুলি ক্যামেরায় তোলা।” এ ছাড়াও থাকবে আক্রান্তদের মডেল।
প্রতিমাতেও থাকছে অভিনবত্ব। সেখানে দুই মেয়ে লক্ষ্মী এবং সরস্বতীকে রক্ষা করছেন দুর্গা। অ্যাসিড হামলাকারীদের আদলে তৈরি অসুর পুড়বে আগুনে। শিল্পীর কথায়, ‘‘অ্যাসিডে মেয়েরা যে ভাবে পুড়েছে, আগুনে পুড়ে সেই ভাবেই নরকের শাস্তি ভোগ করছে অসুর এবং অসুররূপী অ্যাসিড হামলাকারীরা। পুজোয় তুলে ধরা হবে সেটাই।”
পাপাই জানান, কয়েক বছর আগে অ্যাসিড হামলার শিকার হয়েছিলেন তাঁর এক পরিচিত। তার পরে তাঁর বিয়ে হয়েছে, সন্তান হয়েছে। পাপাই বলেন, ‘‘তার পরেই এমন ভাবনার কথা মাথায় আসে।”
বহু দিন ধরে অ্যাসিড আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করা দিব্যালোক রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও শুধু পুজোর থিমেই একে আটকে রাখলে চলবে না। এখনও অনেক আক্রান্ত বিচার পাননি। তাঁদের পাশে থাকতে হবে। সমাজের সর্বস্তর থেকেই অ্যাসিড হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সুর উঠে আসা উচিত।”
যাতে ‘ছপাক’ শব্দটা আর কোনও মেয়েকে শুনতে না হয়। কপাল-গাল বেয়ে নেমে না আসে অসহ দহনজ্বালা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy