প্রতীকী ছবি।
কোভিড পরিস্থিতির পূর্বে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে ছানির কারণে দৃষ্টিহীন হয়ে পড়া মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় দু’কোটি। ভারতে সেই সংখ্যা প্রায় ৮০ লক্ষ, যা বিভিন্ন কারণের প্রেক্ষিতে মোট দৃষ্টিহীনের অর্ধেক! অথচ ঠিক সময়ে ছানির চিকিৎসা হলে দৃষ্টি স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই থাকে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু প্রত্যন্ত বা পিছিয়ে পড়া এলাকায় এ নিয়ে সার্বিক সচেতনতার অভাব বরাবর সেই পথে অন্তরায় হয়েছে। এরই মধ্যে করোনার আতঙ্কে দেশ জুড়ে চোখের চিকিৎসা বন্ধ থাকায় সর্বত্রই সেই সমস্যা বেড়েছে। ভবিষ্যতে ফল মারাত্মক হতে পারে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনের জন্য গত আড়াই মাস ধরে প্রায় বন্ধ ছানি-সহ চোখের যাবতীয় অস্ত্রোপচার। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ছানি পেকে গেলে (হাইপার ম্যাচিওরড) অন্ধত্ব চলে আসে। ফলে আড়াই মাস ধরে চিকিৎসা বন্ধ থাকার পরে অনেক রোগীর ছানির অস্ত্রোপচার হলেও দৃষ্টিশক্তি আর ফিরিয়ে আনা যাবে না বলেই আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকেরা।
আঘাতজনিত কারণ, গ্লকোমা, রেটিনা ডিট্যাচমেন্ট, কর্নিয়া সমস্যা থেকে অন্ধত্বের শিকার রোগীদের চিকিৎসাতেও থাবা বসিয়েছে কোভিড-১৯। থমকে গিয়েছে দৃষ্টিশক্তির সমস্যা থাকা সদ্যোজাতদের চিকিৎসাও। লকডাউনের এই সময়ের মধ্যে জন্ম নেওয়া অপরিণত শিশুদের অনেকেরই দৃষ্টিহীনতা আসবে বলে চিন্তিত চিকিৎসকেরা। কারণ ওই শিশুদের রেটিনা তৈরি হয় না (প্রিম্যাচিওর রেটিনোপ্যাথি)। সেটি তৈরি করতে জন্মের দু’-তিন সপ্তাহের মধ্যে ইঞ্জেকশন দিতে হয়। ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা রিজিয়োনাল ইনস্টিটিউট অব অপথ্যালমোলজি (আরআইও)-সহ কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে করা হয়ে থাকে। কিন্তু করোনার কারণে সর্বত্র কার্যত বন্ধ ওই চিকিৎসা।
আরও পড়ুন: আত্মীয়তায় বাঁধা পড়ে এ শহরই চিনাদের ভাল-বাসা
আরআইও-র অধিকর্তা অসীম ঘোষ জানাচ্ছেন, যেখানে তাঁরা প্রতি মাসে এমন ৪০টি শিশুর চিকিৎসা করেন, সেখানে গত আড়াই মাসে মাত্র চারটি শিশু তাঁদের কাছে এসেছে! প্রতি মাসে সাধারণত গড়ে ১২০০টি ছানি অস্ত্রোপচার হয়ে থাকে। সেখানে গত আড়াই মাসে হয়েছে মাত্র ১৫টি! ওই সময়ের মধ্যে খুব জরুরি অস্ত্রোপচার ছাড়া পুরো পরিষেবাই ব্যাহত হয়েছিল বলে জানাচ্ছেন অসীমবাবু। তাঁর আশঙ্কা, “আগের হিসেব ধরলে শুধু এখানেই ছানির চিকিৎসা করাতে না-আসতে পারায় চোখের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে প্রায় পাঁচশো জনের। দৃষ্টির স্থায়ী ক্ষতি হবে ৬০-৭০ জন সদ্যোজাতের। গ্লকোমার ইঞ্জেকশন না পেয়ে ধীরে ধীরে স্নায়ু শুকিয়ে যাবে বেশ কিছু রোগীর।”
ছানির চিকিৎসা নিয়ে সরকারি স্তরে প্রচার এবং সক্রিয়তায় এ দেশে এক সময়ে এই সমস্যায় খানিক রাশ টানা গিয়েছিল। কিন্তু গড় আয়ুর বৃদ্ধি পরবর্তী কালে ছানির সমস্যা বাড়িয়েছে। এ বার কোভিড-১৯ প্রভাব তাতে অনুঘটকের কাজ করবে বলে মত চিকিৎসক মহলের।
আরও পড়ুন: ঝুঁকি জেনেও ছুটছেন ওঁরা কোভিড-দেহ নিয়ে
লকডাউন কিছুটা শিথিল হতেই তাই ফের চোখের চিকিৎসা শুরু হয়েছে। সংক্রমণ ঠেকাতে দূরত্ব-বিধি মানা, প্রত্যেক রোগীর পরে চেম্বার এবং ওটি জীবাণুমুক্ত করা, মাস্ক-গ্লাভস পরে রোগী দেখা হচ্ছে। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন চিকিৎসক জ্যোতির্ময় দত্তের কথায়, “আপাতত রোগী দেখা হচ্ছে। চলতি মাসেই ছানি-সহ চোখের ভিতরের অস্ত্রোপচার শুরু করব। নিয়ম মেনে চলার ফলে ঘণ্টায় আগের অর্ধেক রোগী দেখা হচ্ছে। আগের তুলনায় অস্ত্রোপচারও এক-তৃতীয়াংশ হবে। এ দিকে জমে রয়েছে গত আড়াই মাসের অস্ত্রোপচার। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়াটা যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ।” এক মাস ধরে রোগী দেখছেন চিকিৎসক অভ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায়। তার কথায়, “ফোনেই রোগীদের সময় বলে দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যেই হাইপার ম্যাচিওরড ছানি এবং রেটিনার জরুরি অস্ত্রোপচার করেছি। সুরক্ষা-বিধি মেনেই ওটি এবং রোগী দেখা হচ্ছে। জুলাই থেকে ছানি ও অন্যান্য অস্ত্রোপচার স্বাভাবিক গতিতে করা শুরু হবে।”
লকডাউন পর্বে টেলি-প্রেসক্রিপশন পদ্ধতিতে শুধু ছোটদের সিজ়নাল ইনফেকশন, বড়দের চোখের বাইরে রক্তক্ষরণের মতো সমস্যার চিকিৎসাই হয়েছে। জ্যোতির্ময়বাবুর মতে, এ বার তাই পরিষেবা স্বাভাবিক করার উপরে জোর না দিলে দীর্ঘস্থায়ী দৃষ্টিহীনতা দ্রুত বাড়বে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy