শববাহী গাড়ির সামনে এক চালক। নিজস্ব চিত্র
‘‘সবাই যদি বাড়িতে খিল দিয়ে বসে থাকেন, তা হলে এই কাজগুলো করবে কে?’’ ছিটকে এল কথাটা।
শহরের রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে শববাহী শকট। পিছনে পুলিশের নজরদারি ভ্যান। তারও পিছনে ছুটছে আত্মীয়দের গাড়ি। শববাহী গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসা চালকের আপাদমস্তক ঢাকা সুরক্ষা-পোশাকে। শকটে রাখা দেহটি প্লাস্টিকে মোড়া। চুল পর্যন্ত দেখার উপায় নেই। হাসপাতাল থেকে সোজা শ্মশান। পিছনে মাঝেমধ্যেই পথ হারাচ্ছে আত্মীয়দের গাড়ি। কখনও আবার ধাপার মুখ পর্যন্ত চলে আসছেন তাঁরা। আত্মীয়দের সেই গাড়ি আটকে দিতে বাধ্য হচ্ছে সঙ্গে থাকা পুলিশের ভ্যান।
ধাপায় পৌঁছে প্লাস্টিকে মোড়া দেহ ট্রে-তে নামিয়ে দিয়েই চালকেরা আবার ছুটে যাচ্ছেন অন্য কারও দেহ নিয়ে আসতে। কখনও কখনও মধ্য কলকাতার কবরস্থানেও নামাতে হচ্ছে দেহ। আত্মীয়স্বজনেরা কেউ না-থাকায় ধাপায় দেহগুলি নিয়ে চলে যাচ্ছেন ডোমেরা। কবরস্থানের ক্ষেত্রে সেখানকার কর্মীরাই কবরস্থ করছেন দেহ।
শববাহী গাড়ির এমনই এক চালক বিকাশকে (নাম পরিবর্তিত) পাওয়া গেল বৃহস্পতিবার সকালে। তাঁর পকেটে রাখা মোবাইল তখনও বেজে ওঠেনি। ফোন এলেই সব কিছু ফেলে রেখে ছুটতে হবে। অভাবের কারণে সপ্তম শ্রেণির পরে আর পড়াশোনা এগোয়নি। গত কয়েক বছর ধরে শববাহী গাড়ি চালাচ্ছেন শহরের রাস্তায়। মাস দুয়েক হল করোনায় মৃতদের দেহ বহনের দায়িত্ব পড়েছে তাঁর কাঁধে। বিকাশের বাবা-মা থাকেন দক্ষিণ কলকাতায়। স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়ে দক্ষিণ শহরতলিতে।
আরও পড়ুন: মেডিক্যালের গ্রিন বিল্ডিংয়েও করোনা রোগী ভর্তি শুরু
ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে না?
‘‘কাউকে না কাউকে তো করতেই হবে। বাড়ি যাওয়া বন্ধ। খারাপ লাগে যখন দেখি, নিকটাত্মীয়কে শেষ বারের মতো দেখার জন্য মরিয়া আত্মীয়দের গাড়ি ধাওয়া করে আসছে। কিন্তু ধাপার শ্মশানে বা কবরস্থানে তাঁদের ঢোকা বারণ। প্রতিটি ইঞ্চি সিসি ক্যামেরায় মোড়া। কলকাতা পুরসভার ঠিক করে দেওয়া জায়গায় আমরা থাকছি। আমি একা নই। এমন ১৪-১৫ জন আছেন। কেউ বজবজ থেকে এসে থাকছেন। কারও বাড়ি মালদহে। কেউ আমার মতো শববাহী গাড়ি চালান। কেউ অ্যাম্বুল্যান্সের চালক। ফোন এলেই চলে যাচ্ছি একটু দূরে, যেখানে গাড়ি রাখা আছে। সেখানে বিশেষ পোশাক (পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট বা পিপিই) পরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি।’’
আরও পড়ুন: আত্মীয়তায় বাঁধা পড়ে এ শহরই চিনাদের ভাল-বাসা
এক-এক দিন হয়তো পরপর ছ’-সাতটি দেহ তুলে পৌঁছে দেওয়ার পরে গাড়ি নিয়ে গ্যারাজে ফেরেন বিকাশ। প্রথমেই পিপিই খুলে তা ছিঁড়ে ফেলতে হয়। এর পরে নিজের পোশাক খুলে তা কাচেন। কাচা হলে ভাল করে স্নান করে ধোয়া পোশাক পরে আবার ফিরে যান পুরসভার ডেরায়। সেখানেই খাওয়াদাওয়া। বিকাশ জানিয়েছেন, মাঝে প্রচণ্ড গরমে পিপিই পরে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন কয়েক জন চালক। এক বার ওই পোশাক পরে নিলে না খাওয়া যায় জল, না যাওয়া যায় শৌচালয়ে। ওই অবস্থায় টানা কয়েক ঘণ্টা ডিউটি করলে শরীর খারাপ লাগতে শুরু করছে। তবু দাঁতে দাঁত চেপে কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরা। বিকাশের কথায়, ‘‘সপ্তাহখানেক হল, চাপটা কমেছে।’’ সরকারের তরফে ১০ লক্ষ টাকার বিমা করে দেওয়া হয়েছে বিকাশদের নামে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy