স্মৃতি: হিমাচলের বড়া সিগরি হিমবাহে (ডান দিক থেকে) ভাস্করদেব মুখোপাধ্যায় ও সন্দীপ ঠাকুরতা। নিজস্ব চিত্র।
হিমাচলের পারাহিও কল (৫৮২৩ মিটার) পেরিয়ে নীচে নেমে দলের সকলের মুখে ফুটেছিল যুদ্ধজয়ের হাসি। অজানা পথে বেরিয়ে একটা পর্ব শেষের আনন্দে সে দিন সহযাত্রীদের জড়িয়ে ধরেছিলেন বেলঘরিয়ার সন্দীপ ঠাকুরতা। উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারেননি ব্যারাকপুরের ভাস্করদেব মুখোপাধ্যায়ও।
দিনটা ছিল ২৪ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার। দুর্গম পাহাড়ি পথে তখন দ্রুত সন্ধ্যা নামছে। বাংলার ছয় ট্রেকারের হাতে থাকা মানচিত্র বলছে, ক্যাম্পে পৌঁছতে তখনও বেশ কিছুটা রাস্তা বাকি। তাই দ্রুত পা চালানো শুরু করেছিলেন সকলে। লক্ষ্য, যত দ্রুত সম্ভব খামিঙ্গার হিমবাহের (৫৪৩৫ মিটার) নীচে ক্যাম্পে পৌঁছনো। আচমকাই দলের বাকি সদস্যেরা খেয়াল করেন, সন্দীপ ও ভাস্করদেবের পা যেন আর চলছে না। তীব্র ঠান্ডা হাওয়া কাটিয়ে এগিয়ে চলার অদম্য ইচ্ছাশক্তিও যেন ক্রমশ হার মানছে তাঁদের প্রচণ্ড ক্লান্তির কাছে। অগত্যা হিমবাহের উপরেই তাঁবুতে উত্তর ২৪ পরগনার ওই দুই বাসিন্দাকে রেখেই এগিয়ে গিয়েছিলেন বাকিরা। সেই শেষ দেখা। পরদিন ভোরে ফের হিমবাহের উপরের ক্যাম্পে যতক্ষণে ফিরে গিয়েছিলেন মোটবাহকেরা, ততক্ষণে সব শেষ। সেই তাঁবু ছেড়ে সন্দীপ-ভাস্করদেব অবশেষে রবিবার সকালে ফিরলেন কলকাতায়। তবে কফিনবন্দি হয়ে।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর কাজ়া থেকে খবর এসেছিল, স্পিতি উপত্যকায় ট্রেকিংয়ে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন স্কুলশিক্ষক সন্দীপ (৪৬) এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী ভাস্করদেব (৬১)। দলের বাকি সদস্যেরা যাতে নির্বিঘ্নে দেহ দু’টি নিয়ে ফিরতে পারেন, তাই তড়িঘড়ি কাজ়া পৌঁছেছিলেন পর্বতারোহী দেবরাজ দত্ত এবং মলয় মুখোপাধ্যায়। তাঁদের সঙ্গেই রবিবার সকালে কলকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছন কফিনবন্দি সন্দীপ-ভাস্করদেব এবং ওই দলের বাকি চার সদস্য— দেবাশিস বর্ধন, অভিজিৎ বণিক, রণধীর রায় এবং তাপস দাস।
তবে কাজ়াতেই দু’টি মৃতদেহের ময়না-তদন্ত করা হয়েছিল। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, উচ্চতাজনিত কারণে প্রচণ্ড ক্লান্তি (অ্যাকিউট মাউন্টেন সিকনেস) এবং অত্যধিক ঠান্ডায় হাইপোথার্মিয়ার কারণেই মৃত্যু হয়েছে সন্দীপ-ভাস্করদেবের।
এ দিন কামারহাটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান পারিষদ বিশ্বজিৎ সাহা ও পানিহাটির কোঅর্ডিনেটর সুদীপ রায় শববাহী গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন কলকাতা বিমানবন্দরে। সেই গাড়ি যখন কফিন নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, তখনই ভেঙে পড়লেন দলনেতা দেবাশিস। “২০১৭ থেকে ২০১৯ সালে তিনটি নতুন পথের ট্রেকিংয়ে ওঁরা আমার সঙ্গী ছিলেন। আজ এ ভাবে বিদায় জানাব ভাবিনি।”— কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন তিনি।
এ দিন বিমানবন্দর থেকে ব্যারাকপুরের ফ্ল্যাটে পৌঁছে গ্যারাজে রাখা হয় ভাস্করদেবের কফিন। তবে নীচে নামেননি স্ত্রী বেণু মুখোপাধ্যায়। বললেন, “অভিযানে যাওয়ার দিনের মুখটা মনে রেখেই আগামী দিনে ওঁর অসমাপ্ত কাজগুলি করতে হবে।” ভাস্করদেবের দাদা রঞ্জিত বললেন, “ফুসফুসের সমস্যা ছিল। মাস ছয়েক আগেই করোনা থেকে উঠেছে। যেতে বারণ করেছিলাম। শুনল না।” ২২ বছর আগে সন্দীপের সঙ্গেই স্কুলে যোগ দিয়েছিলেন সমিত মজুমদার। তাঁর আক্ষেপ, “প্রতি বছর অশিক্ষক কর্মচারীদের পুজোয় জামাকাপড় দিতেন সন্দীপ। এ বার ট্রেকিংয়ে যাওয়ার আগেই দিয়ে গিয়েছিলেন। হয়তো এ জন্যই!” সন্দীপ জানতেও পারেননি, তিনি স্পিতিতে ট্রেকিং করার সময়েই মারা গিয়েছেন তাঁর মা। এ দিন সন্দীপের কফিন বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রতনবাবু ঘাটে, তাঁর মায়ের শেষকৃত্যের জায়গাতেই নিয়ে যান পরিজনেরা।
বারাসতের একটি পর্বতারোহণ ক্লাবের হয়ে ১১ সেপ্টেম্বর কালকা মেলে চেপেছিল ছয় সদস্যের দলটি। লক্ষ্য, মানালির ৯৫ কিলোমিটার দূরে বাতাল থেকে মণিকরণ পর্যন্ত নতুন ট্রেকিং রুট খুঁজে বার করা। ১৫ সেপ্টেম্বর বাতাল থেকে এক জন শেরপা এবং ১১ জন মালবাহকের সঙ্গে যাত্রা শুরু করেন তাঁরা। বড়া সিগরি হিমবাহ, পারাহিও কল পেরিয়ে, খামিঙ্গার হিমবাহ ও হোমস কল (৫৫৬০ মিটার) ছুঁয়ে মণিকরণে পৌঁছনোর কথা ছিল। অভিজিৎ বললেন, “সন্দীপদের জন্য তাঁবু খাটিয়ে সে দিন রাত দেড়টা নাগাদ লাকপা শেরপা ক্যাম্পে ফিরে জানিয়েছিলেন, সন্দীপ সম্ভবত আর বেঁচে নেই! তবে ভাস্করবাবু ঠিক আছেন।” কিন্তু পরদিন সকালেই তিন মালবাহক ফের উঠে দেখেন, সব শেষ। কিন্তু কাউকে খবর পাঠানোর উপায় নেই। তাই এ কজন মোটবাহককে সঙ্গে নিয়ে, দু’দিন ধরে অজানা পথ হাতড়ে ২৭ সেপ্টেম্বর কাজ়ায় পৌঁছে স্থানীয় প্রশাসনকে খবর দেন অভিজিৎ। ফোন করেন কলকাতাতেও। তিনি বললেন, “এর পরে ইন্দো-টিবেটিয়ান বর্ডার পুলিশ, স্কাউড ও মালবাহক মিলিয়ে ৩২ জনকে নিয়ে ফের খামিঙ্গারের দিকে রওনা দিই। রাস্তায় দলের তিন সদস্যের সঙ্গে দেখা হয়। ওঁদের নিয়ে কাজ়া ফিরে আসি। বাকিরা গিয়ে দেহ দু’টি উদ্ধার করে ৩০ সেপ্টেম্বর নেমে আসেন। সেখান থেকে চণ্ডীগড়, দিল্লি হয়ে কলকাতা।”
এ দিন বিমানবন্দর ছেড়ে বেরোনোর পথে পাহাড়প্রেমীরা বললেন, ‘এ বার হয়তো অন্য পথে!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy