অতিথি: নিজের তৈরি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে মোহরকুঞ্জে গানের উৎসবে ড্যানিয়েল ওয়ারো। নিজস্ব চিত্র
তাঁর ছোট্ট দেশে মাঝেমধ্যেই জেগে ওঠে আগ্নেয়গিরি। জেগে ওঠে ফ্রান্সের হাত ছাড়িয়ে স্বাধীন দেশ হয়ে ওঠার স্বপ্নও। আফ্রিকান ক্রীতদাসদের ইতিহাস মাখা সেই দেশে আজও ‘আজাদি’র ধ্বনি ওঠে। ভারত মহাসাগরে ঘেরা, মাদাগাস্কারের অদূরে সেই রিইউনিয়ন আইল্যান্ডের মিশ্র জনজাতির মেঠো সুর ‘মালোয়া’কেই এ বার শহরের বুকে পৌঁছে দিলেন সে দেশের নামী কবি-গায়ক ড্যানিয়েল ওয়ারো।
‘মালোয়া’ কী? উত্তরে ষাটোর্ধ্ব ড্যানিয়েল শুনিয়েছেন তাঁর দেশের গল্প। ফ্রান্সের অধীনে রিইউনিয়ন আইল্যান্ডের বুকে আখ, মশলা চাষ করতে একদা ক্রীতদাসদের নিয়ে গিয়েছিল ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সেই ক্রীতদাসদের বেশির ভাগই আফ্রিকা আর মাদাগাস্কারের। এর পরে আসে ভারত, চিন, আরব দেশের শ্রমিকেরা। ছোট্ট দ্বীপে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকতে শুরু করেন বিভিন্ন দেশের, ভিন্ন সংস্কৃতির সেই মানুষেরা। তৈরি হয় নতুন সংস্কৃতি— ক্রেওল। ধর্ম-বর্ণের ভিত্তিতে সেখানে বিভাজনের সমস্যা থাকলেও ছোট্ট সেই ‘মিলন দ্বীপে’ ক্রমশ একে অপরের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন তাঁরা। খেটে খাওয়া সেই মিশ্র জনজাতির সুর হল ‘মালোয়া’, ক্রীতদাস প্রথার বিলুপ্তির পরেও যা রয়ে গিয়েছে।
মোহরকুঞ্জে ‘সুর জাহান’ সঙ্গীত উৎসবের মাঝে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে ড্যানিয়েল বলে চলেন, ‘‘কালো মানুষদের গান বলে সবাই একে বলত শয়তানের সুর। আমাদের কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে এই গানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় আমার। ষাটের দশকের আগে এই গান গাওয়া হত গরিব, খেটে খাওয়া মানুষদের বাড়িতে। কিন্তু বাইরে তা ছিল নিষিদ্ধ। এমনকি যাঁরা গাইতেন, তাঁরাও মনে করতেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এই সুর ক্ষতিকর। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, পূর্বপুরুষদের সেই সুর, সেই ভাষা আমায় বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আজ মালোয়া মানে তাই আমার কাছে আমার কবিতা, আমার ধর্ম, আমার পরিচয়, বেঁচে থাকার মানে।’’
এই ‘মালোয়া’র হাত ধরেই আজ বিশ্বের দরবারে রিইউনিয়ন আইল্যান্ডের নাম পৌঁছে দিয়েছেন সে দেশের উজ্জ্বল নক্ষত্র ড্যানিয়েল। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে একাধিক জনপ্রিয় অ্যালবাম। ২০১০ সালে পেয়েছেন ওমেক্স সম্মান। জন্ম ১৯৫৫ সালে, ল্য টেম্পন শহরের কাছে একটি গ্রামে। গরিব পরিবারে ছেলেবেলায় গানের সঙ্গে হৃদ্যতার সুযোগ ছিল না তাঁর। তবে বাড়ির পাশে তামিল মন্দিরে পুজোপার্বণে ঢাক-ঢোল-গানবাজনা আকৃষ্ট করতে তাঁকে। পূর্বপুরুষদের এক জন ভারতীয় হিন্দু বলেই হয়তো টানটা ছিল আরও বেশি! তবে ক্যাথলিক খ্রিস্টান ড্যানিয়েলের মা অবশ্য এ সব পছন্দ করতেন না। ‘‘কিন্তু আমার খুব ভাল লাগত তামিল মন্দিরের শোভাযাত্রার পিছন পিছন যেতে। ওঁদের আগুনের উপর দিয়ে হাঁটা, মুখে বাণফোঁড়া— এই সব দেখতে। ওঁদের সঙ্গে একাত্ম বোধ করতাম। পরে আমিও ওই সব করার চেষ্টা করেছি। তাই আমার গানে তামিল ভারতীয়দের কথাও থাকে। ওঁদের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করি। কারণ, সংখ্যালঘু হলেও ওঁরাও তো আমারই অংশ।’’—বলছেন প্রৌঢ়।
এ দেশের সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত ড্যানিয়েলের এটা দ্বিতীয় ভারত সফর। তবে কলকাতায় এই প্রথম। হাঙ্গেরি, সুইডেন, ডেনমার্ক, রাজস্থানের প্রান্তিক মানুষদের গান নিয়ে উৎসবে অংশ নিতে আসা দেশি-বিদেশি শিল্পীদের সঙ্গে চার সঙ্গীকে নিয়ে শহরে এসেছেন ড্যানিয়েলও। সেখানে বাংলার বাউলদের সুরে মুগ্ধ হয়েছেন তিনি। কানে এসেছে এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনের কথাও। শুনেছেন, ধর্মীয় বিভেদের বিরুদ্ধে ‘আজাদি’ স্লোগান তুলে পথে নেমেছেন সাধারণ মানুষ। ঠিক যে ভাবে এক সময়ে সার্বভৌম রিইউনিয়ন আইল্যান্ডের পক্ষে সরব হয়েছিলেন তিনিও। ভারতের ‘বিবিধের মাঝে মিলন মহান’-এর চরিত্র ধরে রাখতে তাই মনুষ্যত্বের প্রতি আস্থা রাখার কথা বলছেন তিনি। ড্যানিয়েলের কথায়, ‘‘মানুষে মানুষে পার্থক্য করা অনুচিত। জাতপাত, ধনী-দরিদ্র হিসেবেও বিভাজন উচিত নয়। ধর্মের ভিত্তিতে ভেদাভেদ না করে বরং সবাইকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। তাতেই কোনও দেশের সার্বিক উন্নতি সম্ভব।’’
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সেই মানুষের কথাই বারবার উঠে আসে ড্যানিয়েলের গানে। ‘‘ক্রীতদাস থেকে মনুষ্যত্বে উত্তীর্ণ হওয়ার পথটা খুব জটিল আর কঠিন। তাই গানের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে বার্তা দিতে চাই যে, আমরাও ভাল। আমাদেরও স্বাধীনতার অধিকার আছে।’’— বড় প্রত্যয়ী শোনায় প্রৌঢ়ের গলা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy