উত্তর কলকাতার দমদম বীরপাড়াতে আমার জন্ম। বাবা, ঠাকুমা ও মায়ের কাছে গল্প শুনেছি, আমাদের পাড়াটা নাকি বেশির ভাগটাই জঙ্গলে ভরা ছিল। তাই সমাজবিরোধীদের আগমন ঘটত। মাঝে মাঝে বোমা পড়ত, খুনও হত। ভয়ে ট্যাক্সি, রিকশাওয়ালা কেউই আমাদের পাড়ায় আসতে চাইত না। এক সময় আমাদের পাড়াতে হাতে গোনা দু’-একটা বাড়ি ছিল। উত্তর কলকাতা বলতে যা বোঝায় গা-লাগোয়া সব বাড়ি, মোটেই সে রকম ছিল না আমাদের অঞ্চল। আমি কিছু টালির ঘর আমাদের পাড়াতে দেখেছি কিন্তু সেগুলো এখন ফ্ল্যাটে পরিণত হয়েছে। কাঁচা রাস্তা এখন পিচের হয়েছে। কলকাতার পিন নম্বর নিয়ে আমার একটা কৌতূহল ছিল ছোটবেলায়। আমাদের পাড়ার পিন নম্বর ছিল কলকাতা-৭০০০৩০। কিন্তু মনে হত কলকাতা- ৭০০০০১, ৭০০০০২ এলাকাগুলিও কি পাশাপাশি জায়গায় অবস্থান করে? তবে আমার পাশের পাড়া কেন ৭০০০৩৭, এর কারণ ঠিক বুঝতে পারতাম না।
আরও পড়ুন, ছকভাঙা মাংসে ভোজের খোঁজ
আমার ছোটবেলা কেটেছে পাড়ার স্কুলে পড়েই। বীরপাড়া অরবিন্দ স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। তার পর দমদম নর্থ এন্ড গার্লস স্কুল থেকে মাধ্যমিক। পাড়ার মাঠেই খেলাধুলা শরীরচর্চা জিমনাস্টিক। পাড়ার বাইরের জগৎ সম্পর্কে তখন কোনও ধারণাই ছিল না। তবে পুজোতে নতুন জামা কিনতে শ্যামবাজার যেতাম বাবা মায়ের হাত ধরে। ভিড় ঠেলাঠেলিতে এতটুকুও ক্লান্ত হতাম না। পাঁচ রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারতাম না বাড়ি কোন দিকে। তখন মা শিখিয়ে দিয়েছিলেন, নেতাজির ঘোড়ার মুখ যে দিকে সে দিকে আমাদের বাড়ি। ফেরার পথে কচুরি তাও বাসভাড়ার পয়সা বাঁচিয়ে। ক্লাব থেকে কয়েক জন সুযোগ পেলাম ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে। সপ্তাহে তিন দিন কলকাতা যাওয়া শুরু হল। যাতায়াতের একমাত্র ভরসা চক্ররেল। দমদম থেকে না টালা থেকে ধরতে হত। বাইরের খাবারের অভ্যাস নেই তাই মুড়ি, ছাতু, চিঁড়ে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। চক্র ধরে ইডেন গার্ডেন। রাস্তা পার হয়ে ঢুকে পড়লাম ক্ষুদিরামে। অনুশীলনের পর রাস্তায় এসে দেখি কত মানুষের ভিড়। মা বললেন এটা স্টেডিয়াম, ভেতরে বড় মাঠ আছে সেখানে ক্রিকেট খেলা হয়। ভেতরে ঢুকে খেলা দেখার সুযোগ হয়নি কখনও। বাবা-মা যেতে দিতেন না যদি হারিয়ে যাই, যদি কোনও গণ্ডগোলের মধ্যে পড়ি। তাই খুব ভয় পেতেন। কিন্তু ক্ষুদিরাম যাওয়া কখনও মিস করতাম না। হয়তো আমার মনের ভেতরে কলকাতার প্রতি ভাল লাগা তৈরি হয়েছিল। বিভিন্ন জায়গার নাম শুনতাম কিন্তু যাওয়ার উপায় নেই।
ছোট থেকেই আমার নাচের প্রতি একটা ঝোঁক ছিল। স্কুলে হোক বা পাড়াতে নাচের অনুষ্ঠান হলে আমি দেখতে যেতাম। ভাল লাগত বলে, নাচ শিখব বলে নয়। কখনও ভাবিনি জিমনাস্টিক ছেড়ে নাচ করব। তখন বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তাই হয়তো নাচ শেখার কথা মাথাতেও আসেনি। কিন্তু মা লক্ষ্য করেছিলেন আমার নাচের প্রতি একটা আকর্ষণ আছে। তখন বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না, তাই টিভিও নেই। পাড়াতে একটা বাড়িতে মহাভারত দেখতে যেতাম। ওই বাড়ির মেয়েটি নাচ শিখতে যেত। তখন মা বললেন তুইও শিখবি? উত্তর ছিল, হ্যাঁ। আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকায় মা মেশিনে সেলাই করে নাচের মাইনে দিতেন। আমার দুই দাদা কাজল হাজরা ও কাশীরাম হাজরাকেও আমিই নাচের জগতে নিয়ে আসি। এ সবের মধ্যে মা চাকরি পেলেন। আর্থিক অবস্থা কিছুটা সচ্ছল হল। মায়ের আই কার্ডে কলকাতা ৭০০০০১ সেই ঠিকানা পেয়ে গেলাম। মাঝেমধ্যে মায়ের হাত ধরে চলে যেতাম ডালহৌসি এলাকায়, লালাবাজার, রাইটার্স, জিপিও ও টেলিফোন ভবনে। মা বলেছেন এই রাস্তা ধরে সোজা চলে গেলে গঙ্গা দেখা যাবে। এ ছাড়া নাচের পোশাকের জন্য বড়বাজারের অলি-গলি চিনেছি মায়ের হাত ধরে। এর পর বড়দা একদিন আমাকে নিয়ে গেল ড. মঞ্জুশ্রী চাকী সরকারের কাছে। অডিশন দিতে ভর্তির সুযোগের সঙ্গে গ্রুপে নাচ করারও সুযোগ পেলাম। প্রথম যখন দিদিকে দেখি সত্যি আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। উচ্চতা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। কপাল জুড়ে টিপ, মাথার উপরে খোপা। শুরু হল দিদির কাছে নাচ শেখা ও পথ চলা। তখন আমি একদম নতুন ক্লাসের মেয়েদের নিয়ে ‘ময়না ছলাৎ ছলাৎ চলে রে’ নাচটা কোরিওগ্রাফি করে দিদিকে দেখাব ঠিক করি। কিন্তু পুরনোদের বক্তব্য ছিল দিদি এই সব গানের নাচ পছন্দ করেন না। তুই দিদিকে এই ধরনের নাচ দেখাবি না। আমি কিন্তু তখন তাদের কথা না শুনেই দিদিকে দেখিয়েছিলাম। দিদি দু’বার আমার নাচটা দেখেছিলেন এবং খুব প্রশংসা করেছিলেন। শুরু হল দিদির হাত ধরে বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান।
তখন বয়সটা খুবই কম, ১৪ কি ১৫। রাস্তাঘাট কিছু চিনি না। মধুসূদন মঞ্চে অনুষ্ঠান। কী ভাবে যাব, কে দিয়ে আসবে! তখন বাবা বললেন আমি বাসে তুলে দেব, চলে যাবি। যথারীতি বাসেও চাপলাম। কিন্তু কিছু দূর যেতে না যেতেই বারবার কনডাক্টারকে জিজ্ঞাসা করছিলাম ঢাকুরিয়া এসে গেছে? কিন্তু উত্তর এল, চুপ করে বসো, জায়গা মতো নামিয়ে দেব। সারা রাস্তা দেখতে দেখতে গেছিলাম। অন্য সময় যখন বাবা-মায়ের সঙ্গে কোথাও যেতাম তখন কিছুটা রাস্তা জেগে থাকলেও বাকিটা ঘুমোতাম। কিন্তু এ বার তো একা, তাই ঘুমোতে পারিনি। ভয় ছিল যদি ঠিক জায়গায় নামতে না পারি। কত মানুষ, কত গাড়ি। জায়গায় জায়গায় খাবারের দোকান। এক বিচিত্র অনুভূতি। আমার মনে হল এই শহরের একটা প্রাণ আছে। সেই দিন অনুষ্ঠানের পর দিদি আমাকে ফিরতে দেননি। দিদির বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। শুরু হল কলকাতার বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন হলে অনুষ্ঠান। সবথেকে বেশি খুশি হতাম রবীন্দ্রসদনের অনুষ্ঠানে। আড্ডা, খাওয়াদাওয়ার একটা ভাল সুযোগ। তাই বারবার মনে হত কবে রবীন্দ্রসদনে যাব। ভাল অনুষ্ঠান থাকলেও দেখতে চলে যেতাম। সোজা কথায় কলকাতা যাওয়ার সুযোগ খুঁজতাম।
এর পর যখন কলকাতার বাইরে গিয়েছি বা দেশের বাইরে যেতে শুরু করি তখন আরও বেশি করে কলকাতাকে মিস করতাম। কিছু দিন কাটার পর বাইরে আর থাকতে ইচ্ছে করত না। বারবার মনে হত কখন কলকাতা ফিরব — ফুচকা, বিরিয়ানি যেন আমায় ডাকছে। অনেক সময় আমার এমনও মনে হয়েছে আজ যেখানে যাচ্ছি সেই দিনটা যদি ফেরার দিন হত ভাল হত। একবার আমাকে একটা দেশে পাঁচ বছর থাকার জন্য বলেছিল। আমার উত্তর ছিল অসম্ভব। কলকাতা ছেড়ে এত দিন আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। আসলে কলকাতা শহরের এই টানটা আমি পৃথিবীর কোথাও গিয়ে পাই না। তবে আমার একটা কথা বার বার মনে হয়, কলকাতাকে আমরা কেন পরিষ্কার রাখি না, সুন্দর করে সাজিয়ে তুলি না!
কলকাতা মানে নন্দন, কলকাতা মানে ভিক্টোরিয়া, কলকাতা মানে ভিড় আর ঠেলাঠেলি। লাইন দিয়ে ঠাকুর দেখা। আমার শহর কলকাতা এক বিচিত্র অনুভূতি। সংস্কৃতি, খেলাধুলা, উৎসব আর অনুষ্ঠান। হাত বাড়ালেই বন্ধু মেলে, আন্তরিকতাতে ভরা। এই সুন্দরী তিলোত্তমা আমাকে বারবার মুগ্ধ করেছে, বারবার টেনে এনেছে নিজের কাছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy