Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus Lockdown

‘ট্রেন বন্ধের সময় বাড়লে শহরের কাজটা থাকবে তো?’

একশো জনের মধ্যে ৭০ জনই গলায় বা থুতনিতে মাস্ক নামিয়ে ঘুরেছি। দূরত্ব-বিধি মানা তো দূর অস্ত্, ভাল করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে খাওয়ার কথাটুকুও মনে রাখিনি।

শুনশান: সংক্রমণ রুখতে বন্ধ লোকাল ট্রেন পরিষেবা। শিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকলেও নেই কোনও যাত্রী। বৃহস্পতিবার।

শুনশান: সংক্রমণ রুখতে বন্ধ লোকাল ট্রেন পরিষেবা। শিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকলেও নেই কোনও যাত্রী। বৃহস্পতিবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

কুণাল বসু (নিত্যযাত্রী)
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০২১ ০৬:২৮
Share: Save:

পাকাপাকি ভাবে কর্মহীন হওয়ার যে আতঙ্ক গত বছর আমাদের মতো রেলের নিত্যযাত্রীদের মধ্যে চেপে বসেছিল, এ বার কি সেটাই সত্যি হতে চলেছে? লোকাল ট্রেন আপাতত দু’সপ্তাহ বন্ধ, ঘোষণা হওয়ার পর থেকে এই চিন্তাটাই মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই সঙ্গে এ-ও মনে হচ্ছে, এমন পরিস্থিতি তো আমাদের জন্যই হয়েছে। যখন সময় ছিল, তখন আমরা মাস্ক পরব না বলে জেদ ধরেছিলাম। একশো জনের মধ্যে ৭০ জনই গলায় বা থুতনিতে মাস্ক নামিয়ে ঘুরেছি। দূরত্ব-বিধি মানা তো দূর অস্ত্, ভাল করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে খাওয়ার কথাটুকুও মনে রাখিনি।

গোবরডাঙার হায়দাদপুরে আমার বাড়ি। বিয়ে করিনি। বয়স্ক মা আর দাদার মেয়েকে নিয়েই আমাদের সংসার। ভাইঝির বাবা-মা অন্যত্র থাকেন। এ বারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সেই মেয়ে ঠাকুরমা ছাড়া আর কিছু চেনে না। আমি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, তখন আমার বাবা মারা যান। পরিবারের পাশে দাঁড়াতে সে সময়ে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে দ্রুত কাজে যোগ দিতে হয়েছিল। এখন কলকাতায় মেয়েদের পোশাক বিক্রির এক সংস্থায় কাজ করি। নাগেরবাজার আর হাতিবাগানে ওই সংস্থার দোকান রয়েছে। সেখানে কাজের সূত্রেই প্রতিদিন ট্রেনে চেপে শহরে আসা।

প্রতিদিন সকাল ৯টা ২৭ মিনিটের ট্রেন ধরে দমদম নামতাম। সেখান থেকে নাগেরবাজারের দোকান হয়ে চলে যেতাম হাতিবাগানে। রাত ১০টারও পরের ট্রেনে বাড়ি ফিরতাম। কিন্তু এই যাতায়াতে ফের দাঁড়ি পড়ে গিয়েছে বৃহস্পতিবার থেকে। শুধু আমার নয়, আমাদের সংস্থায় কাজ করা আমার মতো অনেকেরই। সরকার থেকে দোকান খোলা রাখার যে সময় বেঁধে দিয়েছে, সেটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে সমস্যার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিয়ম মতো এ বার থেকে বাজার-হাট খোলা থাকবে সকাল ৭টা থেকে ১০টা এবং বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। কিন্তু আমাদের মতো পোশাকের দোকানে অত সকালে তেমন খদ্দের হয় না। তার মানে বাকি রইল বিকেলের দু’ঘণ্টা। মাত্র দু’ঘণ্টার এই সময়টুকুর জন্য আমার মতো দূর-দূরান্তে থাকা কোনও কর্মী যদি বাস বা অন্য কিছু ধরে কলকাতায় পৌঁছেও যান, তিনি রাতে ফিরবেন কী করে? বাসের সংখ্যাও তো কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ি ফিরতে না পেরে তাঁকে তো সারা রাত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হবে! তা ছাড়া ট্রেনে এইটুকু পথ যাতায়াতের জন্য প্রতিদিনের খরচ মাত্র আট টাকা। সেখানে দু’টো বাস ও অটো পাল্টে কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত করতেই তো কম করে দিনে ৮০ টাকা বেরিয়ে যাবে।

এখানেই তো কাজ টিকিয়ে রাখাটা সমস্যার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সকলের পক্ষে কি বাসে-অটোয় করে প্রতিদিন কাজে যাওয়া সম্ভব? দু’সপ্তাহ বা এক মাস যেতে না পারলে তবু চালিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু কোনও মালিকই দিনের পর দিন বসিয়ে বসিয়ে কাউকে বেতন দেবেন না! এখনই দু’টো দোকান খুলে রাখতে যদি দৈনিক পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়, তা হলে আয় হচ্ছে তিন হাজার টাকারও কম! দু’সপ্তাহ পরেও যদি পরিস্থিতি একই থাকে, লোকান ট্রেন পরিষেবা যদি তখনও চালু না হয়, তখন খাব কী? ট্রেন বন্ধের সময় বাড়লে শহরের কাজটা থাকবে তো?

গত বছর যদিও আমাকে ও দোকানের আরও এক কর্মচারীকে কলকাতায় থেকে কাজ করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন মালিক। তাতে অনেকটা সুরাহা হয়েছিল। এ বারও যদি সেই সুযোগ মেলে, তা হলেও বয়স্ক মা ও ভাইঝিকে বাড়িতে ফেলে রেখে তো অত দূরে পাকাপাকি ভাবে থাকার জন্য চলে আসতেও পারব না!

ট্রেনে যাতায়াতের সূত্রে বন্ধু হয়ে ওঠা লোকজনের সঙ্গে আজ এই নিয়েই কথা হচ্ছিল। সকলেই ভয় পাচ্ছেন, দু’সপ্তাহ পরেও ট্রেন চালু না হলে কী হবে, তা নিয়ে। কেউ আগের বারের মতো এলাকাতেই আনাজ-মাছ বিক্রির পরিকল্পনা করে ফেলেছেন। কিন্তু তা তো সকলের পক্ষে সম্ভব নয়।

কথায় কথায় এক বন্ধু বলল, “মাস্ক পরতে বললেই যাঁরা এত দিন বলতেন করোনা কিচ্ছু করতে পারবে না, এখন তাঁদের বলা উচিত, করোনায় মরব কি না জানা নেই। তবে লোকাল ট্রেন কয়েক মাসের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে অনেকেই না খেতে পেয়ে মরব।”

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy