কোভিড মোকাবিলায় নেমে জীবনযাপন বদলে গিয়েছে চিকিৎসকদের। প্রতীকী চিত্র।
ভয়টা তখন সবে বাড়তে শুরু করেছে, এখনকার মতো এতটা চেপে বসেনি তখনও। কোভিড-১৯ সংক্রমণ রুখতে জমায়েত, ধর্মস্থান, স্কুল-কলেজ নিয়ে সতর্কবার্তা আর বিধিনিষেধ জারি করা শুরু হচ্ছে। কিন্তু লকডাউন তখনও বেশ কিছুটা দূরে।
দুপুরবেলা দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালের আউটডোরে রুটিন মাফিক রোগী দেখতে বসেছেন জেনারেল মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক অনুপম মাইতি। বছর পঁয়ষট্টির এক রোগী চেম্বারে ঢুকে সামনের চেয়ারে বসলেন। উপসর্গ শুনেই কিছুটা যেন থমকে গেলেন তরুণ চিকিৎসক— পাঁচ-ছ’দিনের জ্বর, গলায় ব্যথা, ফোলা ভাব, মাঝেমধ্যে শ্বাসকষ্ট। হাতে গ্লাভস নেই, যথাযথ পিপিই পোশাকও এসে পৌঁছয়নি... এই রোগীকে ছোঁয়া উচিত হবে?
স্থবিরতা ওই কয়েকটা মুহূর্তেরই। ডাক্তারি শপথ মনে পড়ে গেল সম্ভবত। দ্বিধা ঝেড়ে উঠে পড়লেন। প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে আইসোলেশনেই ভর্তি করলেন। আর দ্রুত লালারসের নমুনা পাঠিয়ে দিলন নাইসেডে। পরের দিন রিপোর্ট এসেছিল— রোগী কোভিড-১৯ পজিটিভ। ১৪ দিনের জন্য কোয়রান্টিনে চলে গিয়েছিলেন চিকিৎসক। বাড়িতেও ফেরেননি। হোটেলবন্দি করে ফেলেছিলেন নিজেকে। আরও কঠিন লড়াইয়ের জন্য তৈরি হয়ে নিয়েছিলেন ওই সময়টাতেই।
বিশ্রামের জায়গায় যাওয়ার আগে পিপিই খুলে নিজেকে পুরোপুরি ‘ওয়াশ’ করতে হয়। প্রতীকী চিত্র।
আরও পড়ুন: শুরুতেই বেলগাছিয়া বস্তি, আজ র্যাপিড টেস্ট শুরু হল রাজ্যে
দিনরাতের হিসেব বদলে গিয়েছে, বাড়ির পরিবেশ বদলে গিয়েছে, জীবনের ছন্দ বদলে গিয়েছে অনুপম মাইতির। কলকাতার যে সব বেসরকারি হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা হচ্ছে, পঞ্চসায়র এলাকায় অনুপমের হাসপাতাল সেগুলোর অন্যতম। অনুপমদের জেনারেল মেডিসিন বিভাগই করোনা চিকিৎসার কান্ডারি। আর অপেক্ষাকৃত তরুণ হওয়ায় অনুপমরা কয়েক জনই একেবারে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে। বয়স ৬০-৬৫ হলে বিপদ বেশি। তাই প্রবীণ চিকিৎসকদের সরিয়ে রেখে কম বয়সিরাই আপাতত লড়াইয়ে। খুব প্রয়োজন না পড়লে এই যুদ্ধক্ষেত্রে বয়স্কদের ডাকতেও চাইছেন না তাঁরা। কিন্তু সে সবের জেরে পরিবার এখন কাছে থেকেও অনেক দূরে।
‘‘মেয়েটার বয়স আড়াই। সে আমাকে দেখলে আর কারও কাছে থাকতে চায় না। কিন্তু কিছুতেই কাছে আসতে দিতে পারছি না। আটকে রাখা যাচ্ছে না। রোজ কান্নাকাটি করছে। কিন্তু কিছু করার নেই এখন।’’ ঠোঁটের ডান পাশে মৃদু হাসির রেখায় স্থিতধী সৈনিকের মতো সংকল্প ফুটে ওঠে। মেয়েকে, স্ত্রীকে, প্রবীণ বাবা-মাকে দূরে রাখতে হচ্ছে। এক বাড়িতে থাকছেন। কিন্তু আলাদা ঘরে তো বটেই, আলাদা ফ্লোরেও।
হাসপাতালে যাওয়ার তাড়া না থাকলে সকালের চা-টা পরিবারের সঙ্গেই খেতে পছন্দ করেন অনুপম। ওই সময়টুকু ইঞ্জিন হিটার হিসেবে কাজ করে তাঁর জন্য। সারা দিনের জন্য চালু হয়ে যান অনুপম। হাসপাতালে কোভিডের জন্য আইসোলেশন ওয়ার্ড চালু হতেই রোজের রুটিন থেকে খসে পড়েছে সকালের ওই পর্বটা। যে ঘরে থাকছেন তিনি, সে ঘরে পরিবারের কারও ঢোকা বারণ। একসঙ্গে চা খাওয়া বা খেতে বসা বারণ। এক বাসনপত্রে খাওয়া-দাওয়া করাও বারণ। অতএব আলাদা ঘর, আলাদা বাথরুম, আলাদা, রান্না, আলাদা বাসন, আলাদা খাওয়া। সারা দিন হাসপাতাল সামলে ফেরার পরেও নিজের সব কিছু নিজে করে নেওয়া। কারণ সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বিধি মানতেই হচ্ছে। সুতরাং পরিচারিকা বা রান্নার লোকেরও ছুটি আপাতত।
আরও পড়ুন: উপসর্গ মিলল ২ জনের, বাইপাসের ধারে ১৫ হাজার মানুষের বস্তি কোয়রান্টিনে
পরিবারকে কেন তাঁর ছোঁয়াচ থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে? তিনি তো করোনায় আক্রান্ত নন। রোগীর সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সময়ে কি যথেষ্ট সুরক্ষিত ভাবে যাচ্ছেন না?
এই প্রশ্নেই শুরু হয়ে যায় আর এক কাহিনি, যা আটকে থাকছে হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডের ভিতরেই। বাইরে থেকে সে কাহিনির আঁচ একটুও মিলছে না।
লকডাউনের বেশ কিছু দিন আগে যখন প্রথম করোনা সন্দিগ্ধের সংস্পর্শে এসেছিলেন, তখনও কলকাতায় সে ভাবে এসে পৌঁছয়নি পর্যাপ্ত পিপিই পোশাক। এখন সে সমস্যা আর নেই। পিপিই পোশাক প্রয়োজন অনুযায়ী মিলছে। কিন্তু ওই পোশাকে এক বার ঢুকে যাওয়ার পরে কী ভাবে কাটছে সময়টা? ‘‘চোখে গগল্স, মুখ-নাক ঢাকতে মাস্ক, তার উপরে হেডমাস্ক (বর্মের মতো), সর্বাঙ্গ ঢাকা অ্যাপ্রন, হাতে গ্লাভস, জুতোর উপর দিয়ে পরে নেওয়া শু-কভার— পূর্ণাঙ্গ পিপিই এটাই। চিকিৎসার প্রতিটা ধাপে এই সব কিছু পরে থাকার দরকার পড়ে না। কিন্তু আইসোলেশন ওয়ার্ডে যে কাজটা আমি করছি, তাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সব কিছু পরে নিতে হয়। আর এক বার পরে নিলে আবার কত ঘণ্টা পরে খুলতে পারব, আমার নিজেরও জানা থাকে না,’’— বলে চলেন অনুপম।
আইসোলেশন ওয়ার্ডে কোনও কোনও দিন টানা ২৪ ঘণ্টা কাটাতে হচ্ছে অনুপম মাইতিকে। প্রতি সপ্তাহে অন্তত দুটো দিন সে রকম আসছেই। আর ২৪ ঘণ্টা আইসোলেশন ওয়ার্ডে আটকে পড়ার অর্থ কী? অর্থ হল প্রায় ২৪ ঘণ্টার জন্যই পিপিই পোশাকে আবদ্ধ হয়ে যাওয়া। তাতে সমস্যা কী? ‘‘সমস্যা?’’ আবার মৃদু হাসেন চিকিৎসক। তার পরে বলেন, ‘‘সমস্যা কিছুই নেই। শুধু আটকে থাকা। মানে খিদে পেলে খাওয়া যাবে না, তেষ্টা পেলে জল খাওয়ার উপায় নেই। যদি মনে হয় এনার্জি কমে আসছে, একটু চা বা কফি পেলে ভাল হত, উপায় নেই। এমনকি টয়লেটে যাওয়ার উপায়ও নেই। পূর্ণাঙ্গ পিপিই পরে থাকা অবস্থায় ও সব কিছুই করা যায় না।’’
খিদে-তেষ্টা নিয়ে অভিযোগ নেই অনুপমদের। ৮-১০ বছরের ডাক্তারি জীবন পার করে এসেছেন, রোগীর দিকে সতর্ক নজর রাখার প্রয়োজন হলে খিদে-তেষ্টার কথা মনেও থাকে না। কিন্তু একটা পিপিই পোশাক এক বার খুলে ফেললে তা আর পরা যায় না, ফেলে দিতে হয়। আবার নতুন পোশাক পরতে হয়। তাই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার আগেও দশ বার ভাবতে হচ্ছে এখন।
আরও পড়ুন: ‘দূরে বাড়ি হলে এখানেই থাকুন’, আর্জি আইডি-র
করোনার উপসর্গ দেখলে আইসোলেশনে ভর্তি করা, আইসোলেশনে চেস্ট এক্সরে করানো, লালারসের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করতে পাঠানো, সাধারণ আইসোলেশনে থাকা রোগীদের দিকে সারা ক্ষণ নজর রাখা, তাঁদের ওষুধ এবং পথ্যের খেয়াল রাখা— সব সামলাচ্ছেন অনুপম মাইতি। কার কখন স্পেশ্যাল কেয়ারের প্রয়োজন, কাকে অক্সিজেন দেওয়া দরকার, খেয়াল রাখছেন। সাধারণ আইসোলেশনে যাঁদের অবস্থার অবনতি হচ্ছে, তাঁদের আইসিইউ-তে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আইসিইউ-এর দেখভালে অবশ্য করছেন অনুপমের অন্য সহকর্মীরা। তবে সব মিলিয়ে সপ্তাহে অন্তত দিন দুয়েক টানা ২৪ ঘণ্টা কাটাতে হচ্ছে আইসোলেশন ওয়ার্ডে। আর সেই দিনগুলোয় কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগও মিলছে খুব কম। বিশ্রামের জায়গা এবং ব্যবস্থা রাখা হয়েছে আইসোলেশন বিভাগের ভিতরেই। ওই বিভাগের চিকিৎসকদের এখন বার বার ওয়ার্ড থেকে বাইরে চলে আসতে হোক, এটা চাইছেন না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাই ওই রকম ব্যবস্থা। কিন্তু ওই বিশ্রামের জায়গায় যাওয়ার আগেও পিপিই খুলে ফেলে, নিজেকে পুরোপুরি ‘ওয়াশ’ করে যেতে হচ্ছে। রোগীর কাছে ফেরার আগে নতুন পিপিই পরে নিতে হচ্ছে। অতএব বিশ্রামের সময়টুকুও খুঁজে বার করতে হচ্ছে খুব হিসেব কষে। পিপিই পোশাকের অফুরান জোগান তো নেই।
বাবা হাসপাতালে রওনা হওয়ার আগে রোজ সকালে আড়াই বছরের মেয়েটা দূর থেকে হাত নাড়ছে। চোখে-মুখে অবুঝ বিক্ষোভ। মা শক্ত করে মেয়েকে ধরে রাখছেন কোলে। বাবাকে ‘টাটা’ করে দিতে বলছেন। কিন্তু মেয়ে চায় কোল থেকে নেমে এক বার অন্তত ছুট্টে গিয়ে বাবার কোলে উঠতে, যার উপায় আপাতত নেই। বিবর্ণ হাসিতে হাতটা নেড়ে গাড়িতে উঠে পড়ছেন অনুপম। কিন্তু সেটুকুই অনেক বলে মনে হচ্ছে তাঁর। যে যুদ্ধে নেমেছেন, তার শেষ কোথায়, অনুপম মাইতি জানেন না। কত দিন পরে আবার সবাই মিলে এক টেবিলে খেতে বসতে পারবেন, বুঝতে পারছেন না। আবার কবে মেয়েটাকে কোলে নিতে পারবেন, হিসেব করে উঠতে পারছেন না। স্ত্রী-র হাত থেকে উষ্ণ কাপ-প্লেটটা নিয়ে যে সকালগুলোয় তরতাজা বোধ করতেন, সেই সকালগুলো আবার কবে ফিরবে, সে-ও জানা নেই। তবু মনকে নিরন্তর বোঝাচ্ছেন দক্ষিণ কলকাতার নামী বেসরকারি হাসপাতালের জেনারেল মেডিসিন বিভাগের তরুণ চিকিৎসক অনুপম মাইতি। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখতে হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এখনও তো রোজ প্রিয়জনদের মুখগুলো দেখা যাচ্ছে। এখনও তো রোজ সকালে মেয়েটা হাত নেড়ে ‘টাটা’ বলছে। হাসপাতালে আইসোলেশন ওয়ার্ড আর বাড়িতে আইসোলেটেড ফ্লোর— এখনও তো দুটোকেই সুরক্ষিত রাখতে পেরেছেন তিনি।
(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।)
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy