শুরু হয়েছিল, মাঝপথে থমকে কাজ। ছবি: সোমনাথ মণ্ডল।
ফুটিফাটা চেহারার দুর্গা কাঠামোটা রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। মাটির প্রলেপ যে বহু দিন আগে পড়েছিল, দেখলেই বোঝা যায়। আচমকা যেন থমকে গিয়েছে আঙুলের স্পর্শ। সিংহের মুখ থেকে বেরিয়ে আছে শুকনো খড়। অসুরের অবস্থাও তথৈবচ। কলকাতার প্রাচীনতম রাজপথ চিত্পুর রোড থেকে কুমোরটুলিতে ঢোকার মুখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল। একটু পরেই বুঝতে পারা গেল, নিঝুম পাড়ার সামনে এ যেন অন্দরের অবস্থার মূর্তিমান প্রদর্শন।
এই ছবিটা ধরা পড়েছিল আমপান আসার আগে। লকডাউন তখন পুরোদস্তুর চলছে। কুমোরটুলির গলির মুখ তখন বাঁশ দিয়ে আটকানো। খাঁ খাঁ করছে ভিতরটা। আমপানের পর গিয়ে দেখা গেল, এ ছবিতে বাড়তি সংযোজন কয়েকটা স্টুডিয়োর উড়ে যাওয়া চাল আর কিছু গুঁড়িয়ে যাওয়া মূর্তি। “আমপানের আর ক্ষতি করার মতো আর ছিলটা কী! কিছুই তো বানাইনি আমরা। যা গেছে তা ওই বিক্রি না হওয়া শীতলা, অন্নপূর্ণা, বাসন্তী”— বলছিলেন প্রবীণ শিল্পী সনাতন পাল। পাশে বসা সুজিত পালের কথা, “আমপান নয়, আমাদের সব খেয়ে নিল করোনায়।”
স্টুডিয়োগুলো সব ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়ানো। ফাঁকে ফাঁকে সরু-অতিসরু গলি-গলতা। প্রত্যেক বছর এ সময়টা এলাকা একেবারে গমগম করে উঠতে শুরু করে। বায়না করতে ছুটে আসেন পুজো কমিটির লোকজন। মাটি-কাঠ-বাঁশ-খড়ের জোগান আসতে শুরু করে। আসতে শুরু করেন কারিগররা। ভিড়ে ঠাসা থাকে স্টুডিয়ো থেকে রাস্তাঘাট। রাস্তা দখল নিয়ে সার দিয়ে দাঁড় করানো থাকে কাঠামো। আর এ বছর? গোটা এলাকা জুড়ে ভয়ঙ্কর এক শূন্যতা।
আমপান নয়, সব খেল করোনায়, বলছে কুমোরটুলি। ছবি: শৌভিক দেবনাথ।
আরও পড়ুন: ভারত একতরফা সিদ্ধান্ত নিলে পরিণতি খারাপ হবে, হুঁশিয়ারি চিনের
দু’একটা স্টুডিয়োর সামনে মাটির প্রলেপ দেওয়া প্রতিমা-কাঠামো দাঁড় করানো নেই যে তা নয়। একটা একচালার মূর্তি মাটির কাজ শেষ করে রোদে শুকোতে দেওয়া হয়েছে। খুব বেশি হলে ফুট চারেক উঁচু। ব্যস্! এমন একটা-দুটোই। বেশির ভাগ স্টুডিয়োতে শুধুই বাঁশের কাঠামো ডাঁই করা। কোথাও কোনও কাজ বা ব্যস্ততার চিহ্নমাত্র নেই।
“শিল্পীরা বায়নার খাতায় আঁচড় কাটতে পারেননি। ক্লাব, উদ্যোক্তারা সব বলছেন— দেখছি। কোনও পাকা কথা হচ্ছে না। বিদেশের বুকিং বাতিল হয়ে গিয়েছে। এমন ভয়বহ পরিস্থিতি আমি কোনও দিন দেখিনি”— বলছিলেন বাবু পাল। পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই বয়স। তিনি নিজে প্রতিমাশিল্পী এবং ‘কুমোরটুলি মৃৎশিল্পী সংস্কৃতি সমিতি’র যুগ্ম সম্পাদক।
এই সব কথাবার্তা চলছিল মে মাসের শেষ দিকে। জুনের এই দ্বিতীয় সপ্তাহে আনলক প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর ছবিটা কিছু বদলালো কি? বাবু পালের কথায়, “বলার মতো কিচ্ছু না। মেলবোর্নে একটা ঠাকুর গেল বটে, কিন্তু হাল কিছুই বদলায়নি। নামী কয়েকজন শিল্পীর কাছে কেউ কেউ খোঁজখবর করেছেন, এই পর্যন্ত। কিন্তু বায়না হচ্ছে না।”
আতান্তরে ৪০ কোটির ব্যবসা
সমিতির হিসেবে কুমোরটুলিতে মূর্তি গড়ার কাজ করেন ৪৬০ জনের মতো শিল্পী। পয়লা বৈশাখের মধ্যে তাঁরা একপ্রস্থ বুঝে যান এ বছর পুজোয় ক’টা প্রতিমা গড়তে হচ্ছে। আষাঢ় মাসে রথের দিন ছবিটা পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে যায়। এ বছর রথ আসতে চলল। কিন্তু সবটাই অস্পষ্ট। হাত গুটিয়েই বসে রয়েছে গোটা শিল্পীপাড়া।
প্রতি বছর এই সময় তুমুল ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায় শিল্পীপাড়ায়। ছবি: শৌভিক দেবনাথ।
গত বছর সাড়ে তিন হাজারের মতো দুর্গাপ্রতিমা গড়েছিল কুমোরটুলি। বিদেশে পাঠিয়েছিল ৫৮টি ফাইবারের মূর্তি। কালীঠাকুর প্রতি বছর তৈরি হয় ১০ থেকে ১২ হাজার। এ ছাড়া বিশ্বকর্মা, লক্ষ্মী, জগদ্ধাত্রী— এই কয়েকটা মাস জুড়েই তো কুমারটুলির আসল ব্যবসা। যাকে বলে ‘সিজন’। এর মধ্যে অবশ্যই সবচেয়ে বেশি টাকার মুখ দেখায় দুর্গাপুজো।
অনেকের মতে— ১৭৫৭ সালে, পলাশীর যুদ্ধের ঠিক পরে, রাজা নবকৃষ্ণ দেবের শারদীয় দুর্গাপুজো থেকেই কলকাতার বর্তমান দুর্গোৎসব এবং কুমোরটুলির প্রতিমাশিল্পের উন্মেষ। কৃষ্ণনগর থেকে তিনি শিল্পী আনিয়েছিলেন। পরে দুর্গাপুজো বাড়তে থাকে। কৃষ্ণনগর থেকে চলে আসা শিল্পীদের স্থায়ী পাড়া হয়ে ওঠে কুমোরটুলি। এখনও সেই দুর্গাপুজোতেই এই পাড়ার খাটাখাটনি-ব্যস্ততা বেশি, ব্যবসাও বেশি।
মাপ অনুযায়ী প্রতিমার বিভিন্ন দাম। আট থেকে নয় ফুটের প্রতিমার ‘সেট’ (লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশকে সঙ্গে নিয়ে) বিক্রি হয় লাখখানেক টাকায়। ১২ ফুটের দাম দেড় থেকে দু’লাখ। বিদেশে পাঠানোর জন্য ফুট পাঁচেকের যে ফাইবারের প্রতিমা তৈরি করা হয়, তার দাম থাকে এক থেকে দেড় লাখের মধ্যে। মোটামুটি যা হিসেব, তাতে সব মিলিয়ে গত বছর শুধু দুর্গাপ্রতিমাই বিক্রি হয়েছে ৪০ কোটি টাকার বেশি।
এ বছর করোনা আর লকডাউনের কোপে ইতিমধ্যেই কয়েকটা পুজোর বাজার চলে গিয়েছে শিল্পীদের। মার্চের শেষে ছিল বাসন্তী পুজো। মার্চ থেকে এপ্রিল শীতলা পুজোর মরসুম। এপ্রিলে ছিল অন্নপূর্ণা পুজোও। জুনে মনসা। বড় মরসুম আসার আগে, এগুলোও একটা আয় দেয় কুমোরটুলিকে। বিশেষত অনামী শিল্পীদের।
এ বারের পরিস্থিতি নিয়ে কথা হচ্ছিল নামী শিল্পীদের একজন নবকৃষ্ণ পালের সঙ্গে। সাবেকি প্রতিমার পাশাপাশি থিমের মূর্তি গড়াতেও নামডাক রয়েছে তাঁর। তিনি জানালেন, “গত বছর ৪৭টা প্রতিমা গড়েছি। এ বছর কী হবে তার ঠিক নেই। রথের দিন থেকে জগদ্ধাত্রী পুজো পর্যন্ত জোর কদমে কাজ হয়। এ বার বায়নাই নেই। সরস্বতী পুজোর আগে উত্তর কলকাতার একটা বড় ক্লাব যোগাযোগ করেছিল। তাঁরা হয়তো ঠাকুর বানাবেন। কিন্তু ছোট হবে। শেষ পর্যন্ত কতটা কী হবে অবশ্য বুঝতে পারছি না একেবারেই।”
একই সুর শোনা গেল পশুপতি রুদ্রপালের গলাতেও। তাঁর তিনটি ১২ ফুটের দুর্গাপ্রতিমায় মাটির প্রলেপ পড়েছিল। করোনার জেরে তার পর সব কিছু থেমে। পশুপতিবাবুর কথায়, “এমনও যে হতে পারে, তা কখনও ধারণাই করিনি। বায়না নেই। সবে দু’একটা মূর্তি তৈরি করছিলাম। বন্ধ রাখতে হয়েছে। আদৌ প্রতিমা বিক্রি হবে কি না, তাও তো জানি না। ক্লাবগুলো হয়ত ছোট করেই এ বার সেরে নেবে পুজো। অনেক কারিগর, শ্রমিক এই পেশার সঙ্গে যুক্ত। সবার আয় বন্ধ।”
সহশিল্পী, কারিগর, শ্রমিকরা সংখ্যায় আরও বেশি
কুমোরটুলির শিল্পীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেন বহু সংখ্যক কারিগর। জোগাড়ের কাজ করা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। দুইয়ে মিলিয়ে তিন হাজারের বেশি।
কারিগররা প্রধানত আসেন নদিয়া, মেদিনীপুর, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ থেকে। এই ক’মাস স্টুডিয়োতে থেকেই কাজ করেন। যে শিল্পীর কাছে থাকেন, সাধারণত তিনিই শ্রমিকদের জন্য দু’বেলার খাবারের ব্যবস্থা করেন।
খুলবে তো? কতটা? এখনও জানে না কুমোরটুলি। ছবি: শৌভিক দেবনাথ।
ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ থেকে শুরু হয়ে যায় দুর্গা প্রতিমা তৈরির তোড়জোড়। তার মধ্যে অবশ্য শীতলা, অন্নপূর্ণা, বাসন্তী পুজোর প্রতিমার বরাতও থাকে। সেই সময় কম মজুরিতেই কাজ চলে। দুর্গা গড়ার সময় মজুরি অনেকটা বেশি হয়ে যায়। কারিগররা দিনে ৫০০ থেকে শুরু করে ২০০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পেয়ে থাকেন দক্ষতা অনুযায়ী।
এ বার দুর্দশা আর দুশ্চিন্তা গ্রাস করে রয়েছে এই সাড়ে তিন হাজার মানুষকেও। এঁদের কেউ কেউ ৩০ বছর ধরে এ সময় কুমোরটুলিতে চলে আসেন কয়েক মাসের জন্য। ১০-১৫ বছর ধরে আসছেন এমন মানুষের সংখ্যা অনেক। এ বার লকডাউনের আগে কয়েকজন চলেও এসেছিলেন। আটকে পড়েন কর্মহীন অবস্থায়। বাকিদের ঘন ঘন ফোন এসেছে কলকাতার কুমোরপাড়ায়। “দাদা, কিছু খবর আছে? দাদা, কী হবে এ বার? এমন ফোন এসেই চলেছে আমাদের কাছে”— বলছিলেন কুমোরটুলির এক শিল্পী।
কুমোরটুলি এবং অনুসারী ব্যবসা
কুমোরটুলিতে ঠাকুর গড়া হয়। কাঠামোর উপকরণ, মাটি থেকে শুরু করে কিছু কিছু সাজসজ্জা— সব আসে বাইরে থেকে। নানান জেলা থেকে যেমন কুমোরটুলিতে কাজ করতে আসেন কয়েক হাজার মানুষ, তেমনই বাইরের অনেক এলাকা কাজ পায় কুমোরটুলিকে ঘিরে।
প্রতিমার কাঠামো তৈরিতে লাগে বাঁশ। বর্ধমান-নবদ্বীপ-মুর্শিদাবাদ থেকে আসে সেগুলি। শুধু দুর্গাপুজোর জন্যই লাগে ৬০ থেকে ৭০ হাজার বাঁশ।
গত বছর দুর্গাপুজোর জন্য প্রায় দেড় লক্ষ বান্ডিল খড় কিনতে হয়েছে কুমোরটুলিকে। খড় আসে মূলত ঘাটাল আর পানিহাটি থেকে। কাঠামোতে খড় বাঁধার পর, এঁটেলমাটির সঙ্গে ধানের তুষ মাখিয়ে প্রথমে প্রলেপ দেওয়া হয়। শিল্পীদের ভাষায় বলা হয় ‘এক মেটে’। এর পর আবার প্রলেপ পড়ে। শুকোনোর পর বালিমাটি দিয়ে ধীরে ধীরে প্রতিমার রূপ দেওয়া হয়। তাকে বলে ‘দো মেটে’। খড়িমাটি লাগে সব শেষে।
ভাল এঁটেল মাটি এবং বেলে মাটির উপরে প্রতিমার গড়ন নির্ভর করে। এঁটেল মাটি উলুবেড়িয়া, ডায়মন্ড হারবারের জমি থেকে আসে। নদী পথে কুমোরটুলিতে পৌঁছয়। আর বেলে মাটি নিতে হয় নদী থেকে। কয়েক হাজার ট্রলি মাটি ঢোকে দুর্গাপুজোর আগে। এই কর্মকাণ্ডে অনেক শ্রমিক যুক্ত থাকেন। মাটি নদী পথে আসার পর, সেখান থেকে স্টুডিয়োর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন শ-খানেক শ্রমিক।
আরও পড়ুন: ৪৫ বছর আগে শেষ বার গুলি চলেছিল ভারত-চিনের মধ্যে, সাক্ষী অরুণাচলের মাগো
হাওড়ার আমতায় তৈরি হয় প্রতিমার চুল। সেখানে ৫০ থেকে ৬০ ঘর এই পেশার সঙ্গে যুক্ত আছে। শুধু দুর্গাঠাকুরই তো নয়, অন্যান্য প্রতিমারও ক়ৃত্রিম চুল তৈরি করেন এঁরা।
এ ছাড়া লাগে কাপড়, রং। গয়না আর শোলা-জরির কাজেও যুক্ত অনেক মানুষ। তবে এঁরা থাকেন কুরটুলির ভিতরে বা আশেপাশেই।
অর্থাৎ, শুধু কয়েকশো শিল্পী আর বাইরে থেকে আসা কয়েক হাজার কারিগর এবং জোগাড়েই নন, কুমোরটুলির ভিতরে-বাইরে আরও বহু মানুষ অনিশ্চয়তায় পড়ে রয়েছেন এই সঙ্কটে। অনেকে বিকল্প কাজ করতেও নেমে পড়েছেন পেট চালানোর তাড়নায়। যেমন খাস কুমোরটুলিরই কেউ কেউ এখন পিপিই সেলাইয়ের কাজ করছেন। যে করোনা ডুবিয়েছে, সেই করোনাকেই যেন খড়কুটো করে ভেসে থাকার চেষ্টা। আর তাকিয়ে থাকা... কী হবে শেষ পর্যন্ত, কে জানে...
গ্রাফিক্স: শৌভিক দেবনাথ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy