Advertisement
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
Coronavirus in West Bengal

মুখ দিয়ে এঁকে ছোঁয়াচ বাঁচানোর পাঠ স্কুলশিক্ষকের

স্কুল খোলা থাকলেও প্রতিদিন সকাল সাড়ে ছ’টায় রাজাবাজার নর্থ রোডে বড় মসজিদের কাছে মাস্টারজির বাড়ি পৌঁছে যায় সে।

প্রচার: মুখে কলম দিয়ে এঁকে রাজাবাজার এলাকায় সামাজিক দূরত্বের গুরুত্ব বোঝাচ্ছেন মহম্মদ জাফরুদ্দিন। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

প্রচার: মুখে কলম দিয়ে এঁকে রাজাবাজার এলাকায় সামাজিক দূরত্বের গুরুত্ব বোঝাচ্ছেন মহম্মদ জাফরুদ্দিন। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

নীলোৎপল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২০ ০১:৪০
Share: Save:

জন্ম থেকেই তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। কাজ করে না দু’হাতও। মুখ দিয়ে কলম ধরেই স্কুলে পড়ান তিনি। লকডাউনে স্কুল বন্ধ থাকলেও শিক্ষাদান বন্ধ রাখেননি রাজাবাজার সরকারি হানিফা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মহম্মদ জাফরুদ্দিন। প্রতিদিনই এক ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে রাজাবাজার এলাকায় ঘুরে মুখে কলম ধরে এঁকে বোঝাচ্ছেন করোনা মোকাবিলায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ছোঁয়াচ বাঁচানোর গুরুত্ব। জানাচ্ছেন, ওই এলাকার কিছু মানুষের অসচেতনতা তাঁকে লকডাউনের শহরে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঘর থেকে বেরোতে বাধ্য করছে।

খাতায় নির্দিষ্ট দূরত্বে কয়েকটি বৃত্ত এঁকে জাফরুদ্দিন বলছেন, “অকারণ, বাড়ি থেকে বেরোবেন না। প্রয়োজনে বেরোতে হলে এমন বৃত্ত কল্পনা করে পরস্পরের থেকে দূরে দাঁড়াবেন।” গলায় ঝোলানো গামছা দেখিয়ে এর পরে তাঁর সতর্কবার্তা, “মাস্ক অবশ্যই পরবেন। জানি, অনেকেরই মাস্ক কেনার টাকা নেই। তাঁরা বাড়িতে থাকা পরিষ্কার কাপড় বা আমার মতোই ধোয়া গামছা দিয়ে নাক-মুখ ঢাকুন।” শেষ জাফরুদ্দিনের শিক্ষাদান। পরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছতে মাস্টারের সাইকেল ভ্যান ঠেলে এগিয়ে যায় মুখে কাপড় ঢাকা বছর তেরোর সঙ্গী ছাত্র।

স্কুল খোলা থাকলেও প্রতিদিন সকাল সাড়ে ছ’টায় রাজাবাজার নর্থ রোডে বড় মসজিদের কাছে মাস্টারজির বাড়ি পৌঁছে যায় সে। ছাতার বাঁট দিয়ে দরজায় টোকা মেরে অপেক্ষা কিছু ক্ষণের। বাড়ির লোক ধরে মাস্টারকে সাইকেল ভ্যানে বসিয়ে দিলে পিছনে ছাতা ধরে ঠেলে সে। স্কুলে পৌঁছে দারোয়ানকে ডেকে দোতলার ক্লাসঘরে মাস্টারকে তুলে নিজেও বসে ক্লাসে। বোর্ডে লেখার দরকার পড়লে ডাক পড়ে তার। স্কুল ছুটির পরে মাস্টারকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ছুটি ছাত্রের। জাফরুদ্দিন বলেন, “আমাদের স্কুলে যে ছেলেরা পড়ে, তারা অনলাইনে পড়াশোনার কথা ভাবতে পারে না। সারাদিন খেলে বেড়াচ্ছে। বিধিনিষেধের তোয়াক্কাই নেই! তাই রাজাবাজার এলাকার মানুষদের সচেতন করতে রোজই বেরোতে হচ্ছে। পথে কোনও ছাত্রের সঙ্গে দেখা হলে লেখার কাজ দিয়ে আসি। পরে গিয়ে দেখে দিই।”

আরও পড়ুন: খেজুর, বাদামের জন্য আবদার আফতাবের

ঘিঞ্জি রাজাবাজারেও অবশ্য মাস্টারের বাড়ি খোঁজা কঠিন হয়নি। গলি, তস্য গলি পার করে টালির চালার বাড়ি। “মুখ দিয়ে লেখেন তো? ওটাই মাস্টারের ঘর।” দেখিয়ে দেন পাড়ার লোকেরাই। বাড়ির সরু গলির দু’দিকে পরপর ঘর। তারই একটি ঘুপচি ঘরে স্ত্রী বেনজির জাফর এবং দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকেন জাফরুদ্দিন মাস্টার। নীলচে রঙের দেওয়াল। ঘরের প্রায় পুরোটাই ঢাকা পড়েছে চৌকিতে। চৌকির নীচে চটে বসে রাতের রান্নার আনাজ কাটছেন বেনজির। উপরে বসে পড়াশোনা করছে তাঁদের বছর আটেকের মেয়ে। ঘরের দরজার বাইরে সরু গলিতে রাখা স্টোভ জ্বলছে। সেখানে বসেই জাফরুদ্দিন বলে চলেন, “বাড়ির লোক পড়াতে চাননি। আমিই পুরসভার স্কুলে ভর্তি হই। সেই সময়ে একটি কাঠের পাটাতনের নীচে চারটে চাকা লাগিয়ে তাতে বসে স্কুলে যেতাম। মাধ্যমিক পাশ করে ফোনের বুথে কাজ নিয়েছিলাম।” জাফরুদ্দিনের সেই ভাগ্যের চাকা ঘুরেছিল স্ত্রী বেনজিরের চেষ্টায়। তিনিই স্বামীকে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের কার্ড করিয়ে দেন। তাতেই আসে চাকরির সুযোগ। লেখা পরীক্ষায় পাশ করলেও ইন্টারভিউয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘এই শারীরিক অবস্থায় পড়াবেন কী ভাবে? বোর্ডে লিখতেই তো পারবেন না!’ জাফরুদ্দিনের উত্তর ছিল, ‘‘ছাত্রদের মধ্যে থেকেই কাউকে তৈরি করে নেব। যে আমার হয়ে বোর্ডে লিখবে। পড়া বুঝিয়ে দেওয়াই তো আসল!” অবশেষে ২০১০ সালে চাকরির নিয়োগপত্র আসে এই ঠিকানায়।

আরও পড়ুন: ফের বৃদ্ধকে ফেলে ‘পালাল’ অ্যাম্বুল্যান্স

“আমার মতো কাউকে যখন ভিক্ষা করতে দেখি, বলি পড়াশোনা করতে। চেষ্টা করলে অসম্ভব কিছুই নয়। দেখবেন, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়েও আমরা জিতব। মানুষ জিতবেই। চেষ্টাটা চালিয়ে যেতে হবে।” বলে ওঠেন জাফরুদ্দিন।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus in West Bengal School Teacher Rajabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy