কলকাতা বিমানবন্দরে বিদেশিরা। —ফাইল ছবি
করোনা বিপর্যয়ে দেখা গিয়েছে, এক ধরনের রাজনৈতিক মতাদর্শ আমাদের এই আত্মকেন্দ্রিকতার প্রবণতাকে বাড়িয়ে চলেছে। যেখানে শুধু ভারত নয়, গোটা বিশ্ব জুড়েই এক অদ্ভুত ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তা হল, আমি খারাপ আছি বা আমার যা কিছু খারাপ হচ্ছে তার জন্য দায়ী অন্যরা― যারা ঠিক আমার মতো নয়, ভিন্ন ধর্ম/ ভিন্ন ভাষা/ ভিন্ন জাতি/ ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। এই ‘বহিরাগত’ কিংবা ‘ভিন্ন’-র ধারণা কখনও ভাষা, কখনও জাতি, কখনও ধর্মকে ঘিরে আবর্তিত হয়ে চলেছে। বারবার মনে করানো হচ্ছে, আমার যা পাওয়ার কথা ছিল সে সব পাচ্ছি না, যার মূল কারণটাই হল এই ‘বহিরাগত’ কিংবা ‘ভিন্ন’-দের উপস্থিতি। এই ধারণা নতুন নয়। আমরা অতীতে দেখেছি, জার্মানিতে হিটলারের মতো একনায়কের উদ্ভবও এই ধারণাকে ভিত্তি করেই। এই ধারণা বর্তমানেও অত্যন্ত সচেতন ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের এই যূথবদ্ধ আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতা ও হিংস্রতার চাষাবাদ হয়তো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেও অনেকাংশে নিহিত।
অন্য দিকে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ দেখিয়ে দিল, মানুষের হাতে তৈরি রাষ্ট্রের লৌহদৃঢ় সীমানা কিছুই নয়! একের পর এক রাষ্ট্রের নিশ্ছিদ্র সীমানা তছনছ করে, ভৌগোলিক দূরত্ব উড়িয়ে ধনতন্ত্রের যাবতীয় গর্ব চূর্ণ করে সংক্রমণ অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়ার মতোই যেন অপ্রতিরোধ্য। দেখিয়ে দিল, ধনতন্ত্রের শিখর ছোঁয়া পরাক্রমশালী রাষ্ট্রনায়কও বিশেষ পরিস্থিতিতে হাত পাতেন তৃতীয় বিশ্বের এক দেশের কাছে! একাকার হয়ে গেল উন্নত, উন্নয়নশীল আর অনুন্নতর ভেদ-রেখা! এই ভাইরাস এটাও হয়তো শিখিয়ে গেল, স্বার্থপর-আত্মকেন্দ্রিক যাপন আর আগ্রাসী ধনতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ দিয়ে বিপর্যয় রোখা যায় না! তা রুখতে যৌথ ভাবে বাঁচতে শিখতে হয়! আরও সামাজিক, অন্যের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে উঠতে হয়। বৈষম্যকে দূর করে সমাজের পিছিয়ে থাকা অংশকেও টেনে তোলা জরুরি! আজ যখন উচ্চ ও মধ্যবিত্তের আর্তনাদ শুনি, ‘বস্তির লোকেরা কিছু মানছে না’, ‘ঘরে থাকছে না ওরা’, ‘ওরাই ছড়িয়ে দেবে সংক্রমণ’― মনে পড়ে যায় সেই অমোঘ পংক্তি, ‘যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে/ পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে’।
আমরা এই মানুষদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা আত্মসম্মানের সঙ্গে বাঁচার অধিকার নিয়ে কথা বলিনি। আজ আমরা আতঙ্কিত এই ‘সংক্রমণ-প্রবণ’ মানুষদের নিয়ে! এ আমাদেরই নির্লিপ্ততা, উদাসীনতা আর হিরণ্ময় নীরবতার পরিণতি! এই ভাইরাস হয়তো এই শিক্ষাও দিল, রাষ্ট্রের কর্ণধারদের সামনে এ বার জোরালো কণ্ঠে দাবি উঠুক, পরিবেশ ধ্বংস করে ‘কর্পোরেটের উন্নয়ন’ আর প্রতিবেশীর কাছে শক্তির আস্ফালনে প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে ঢের জরুরি দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জীবনযাপনের মানোন্নয়নে খরচ।
সাধারণ মানুষের ভোটে নির্বাচিত সরকার দেখিয়ে দিল, কতখানি অমানবিক, নির্লিপ্ত, উদাসীন, প্রতিহিংসাপরায়ণ হওয়া যায় দেশবাসীর উপরে! বিভিন্ন মহল, বিশেষজ্ঞ থেকে বিরোধী দলনেতাদের অনেকে সরকারকে সতর্ক করা সত্ত্বেও এ দেশের বিমানবন্দরে প্রয়োজনীয় স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থাই হয়নি, সংক্রমিত দেশ থেকে আসা বিমানযাত্রীদের কোয়রান্টিন কিংবা আইসোলেশনে পাঠানোর কোনও ব্যবস্থা করেনি। যখন করোনার থাবা চিন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনামের সীমানা পেরিয়ে ইউরোপ, আমেরিকাকে গ্রাস করল তখন সরকারের টনক নড়ল।
কী ব্যবস্থা নিল আমাদের সরকার?
আগাম ঘোষণা ছাড়াই মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিসে জারি হল পুরো দেশে ‘লকডাউন’! সব জেনেও একেবারে শেষ মুহূর্তে সরকারের এই তৎপরতার ব্যাখ্যা চূড়ান্ত অযোগ্যতা ছাড়া আর কী হতে পারে। এই বিপর্যয়ের পরে দেখলাম, দিল্লি ও হরিয়ানা থেকে উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের বাড়িতে হেঁটে ফিরতে থাকা অসংগঠিত শ্রমিকদের উপরে তাঁদেরই রাজ্যে হোস পাইপে ‘ক্লোরিন-জল’ ছিটিয়ে ‘স্যানিটাইজ়’ করার মতো হাস্যকর এবং অমানবিক কাজ!
এই বিপর্যয়ের সময়েও কৌশলে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে নানা ভাবে উস্কে দেওয়ার মতলব সরকার পক্ষের নানা বক্তব্যে, আচরণে বারবার স্পষ্ট হয়েছে। করোনা-আক্রান্তকে চিহ্নিত করা হচ্ছে ধর্মের ভিত্তিতে! কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র বলছেন, একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জমায়েত থেকেই তিরিশ শতাংশ সংক্রমণ! এত নিশ্চিত কী ভাবে হলেন তিনি? বাকি সত্তর শতাংশ সংক্রমণের উৎসও তা হলে বলা হোক! করোনাভাইরাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাষ্ট্রের মদতে ‘ধর্মীয় ভাইরাস’-এর সংক্রমণ হচ্ছেই।
এগুলি কি বিপর্যয়কালে মানুষের প্রতি এ দেশের কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের মানবিক আচরণ! এঁরাই বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসেন।
করোনা সংক্রমণ থেকে কি আমরা কিছুই শিখব না? যদি প্রয়োজনীয় শিক্ষাগুলি নিতে পারি, তা হলে হয়তো আরও একটু ভাল ভাবে, অন্যের সঙ্গে মিলেমিশে বাঁচতে পারি। আগামী দিনে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে আসন্ন আরও বিপর্যয়ও যৌথ ভাবে সামলাতে পারি।
অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy