রবি-মূর্তির আবরণ উন্মোচন অনুষ্ঠানের ফলকেও নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে দেবাঞ্জন দেবের নাম। বৃহস্পতিবার বিকেলে তা মুছে দেওয়া হয়। তালতলায়। নিজস্ব চিত্র
বাগড়ি মার্কেটের মতো খোলা বাজারে কি করোনার প্রতিষেধক বিক্রি হয়? কসবায় প্রতিষেধক দুর্নীতি-চক্র ফাঁস হওয়ার পরে অভিযুক্তের বিভিন্ন দাবি ঘিরে এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে নানা মহলে। এই ঘটনায় ধৃত দেবাঞ্জন দেব পুলিশি জেরায় প্রথমে ওই প্রতিষেধক বাগড়ি থেকে কিনেছে বলে দাবি করলেও পরে আরও কয়েকটি জায়গার নাম বলে। সে দাবি করেছে, কসবার পাশাপাশি আরও কিছু জায়গায় এমন প্রতিষেধক শিবির করেছিল। সোনারপুরে শিবির করে গ্রহীতাদের কসবায় নিয়ে আসা এবং আমহার্স্ট স্ট্রিট সিটি কলেজে শিবির করার কথাও উঠে এসেছে। তদন্তকারীরা জেনেছেন, কোথাও পুরসভার ব্যানার, কোথাও ক্যালেন্ডার টাঙিয়ে প্রতিষেধক দেওয়া হয়েছে। দেবাঞ্জনের দাবি, কোভিশিল্ড-কোভ্যাক্সিনের পাশাপাশি স্পুটনিক ভি-ও দিয়েছিল সে! কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, দিনের পর দিন শিবির চললেও পুলিশ কিছু জানতে পারল না কেন? একই সঙ্গে পুরসভা দাবি করেছে, কসবায় আদৌ করোনার প্রতিষেধক দেওয়া হয়নি।
উল্লেখ্য, কসবায় ১০ দিন ধরে ভুয়ো প্রতিষেধক শিবিরের অভিযোগ প্রকাশ্যে আসে বুধবারই। ধৃত দেবাঞ্জন নিজেকে কখনও আইএএস অফিসার, কখনও পুরসভার যুগ্ম কমিশনার, আবার কখনও ক্রিকেটার বা চিত্রনাট্যকার হিসেবে পরিচয় দিত। বৃহস্পতিবার জানা গিয়েছে, সিটি কলেজে গত ১৮ জুন প্রতিষেধক শিবির করেছিল সে। কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, প্রথমে মাস্ক ও স্যানিটাইজ়ার বিলি নিয়ে কথা হলেও তাঁদের প্রতিষেধকের গুরুত্ব বোঝায় ধৃত যুবকই। এ-ও দাবি করে, তখনও পর্যন্ত অমিল স্পুটনিক-ভি দেবে সে।
কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, শিবিরের দিন দেবাঞ্জনের সংস্থা ছাত্র, প্রাক্তন ছাত্র, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী-সহ প্রায় ১০০ জনের মধ্যে অধিকাংশকে ‘কোভিশিল্ড’ দিলেও অন্তত দু’জনকে ‘স্পুটনিক ভি’ দেওয়া হয়েছে বলে জানায়। কয়েক জন ছাত্র জানিয়েছেন, ল্যাবরেটরিতে হওয়া শিবিরের ছবি তোলা নিয়ে ঘোর আপত্তি ছিল দেবাঞ্জনের। কয়েক জন ছবি তোলার কথা বললে বিষয়টি বচসা পর্যন্ত গড়ায়। ওই দিন প্রতিষেধক নেওয়া এক ছাত্র অর্কনীল দাস বলেন, ‘‘দেখলাম সবই হচ্ছে, কিন্তু খুব গোপনে। ছবি তোলা বারণ, সংবাদমাধ্যমকে বলাও বারণ। মোবাইলে মেসেজ আসা নিয়েও ধোঁয়াশা রেখে দেওয়া হয়। বলা হয়েছিল, তিন–চার দিন পরে মেসেজ আসবে।’’ বৃহস্পতিবার এ সবই লিখিত ভাবে জানিয়েছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ।
পুলিশ জেনেছে, এর আগে সোনারপুর স্টেশন চত্বরে মাস্ক ও স্যানিটাইজ়ার বিলির শিবির করেছিল অভিযুক্ত। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিধায়ক লাভলি মৈত্র ও জেলার শ্রমিক নেতা শক্তি মণ্ডল। লাভলি বলেন, ‘‘দেবাঞ্জন জানান, করোনা আবহে গরিবদের পাশে থাকার জন্য তাঁর এই প্রয়াস। এখন শুনছি, তিনি ভুয়ো পরিচয়ে প্রতিষেধক দিয়েছেন।’’ শক্তিবাবু বলেন, ‘‘ওই দিন কর্মী বৈঠকে যাওয়ার পথে দেবাঞ্জনের শিবিরে গিয়েছিলাম। তিনি পুরসভার যুগ্ম কমিশনার বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু কোন সালে আইএএস হয়েছেন, সেই জবাব এড়িয়ে যান।’’ কিন্তু ওই শিবির সম্পর্কে পুলিশের কাছে খবর ছিল না? বারুইপুর পুলিশ সূত্রের খবর, রেল পুলিশের এলাকায় শিবির হওয়ায় তাদের তরফে খোঁজ নেওয়া হয়নি।
এর আগে পুরসভার এক শীর্ষ কর্তাও দেবাঞ্জনের বিরুদ্ধে নিউ মার্কেট থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। জানা গিয়েছে, পুরসভায় চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নাম করে একাধিক তরুণ-তরুণীর থেকে নথি জমা নিয়েছিল দেবাঞ্জন। এমনকি, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তালতলায় একটি অনুষ্ঠানে তার নামের পাশে লেখা ছিল, ‘মুখ্য উপদেষ্টা, যুগ্মসচিব, রাজ্য সরকার’। তার পরেও কেন পুলিশ সতর্ক হল না, সেই প্রশ্ন উঠছে। এ দিন নিউ মার্কেট থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক জানান, ছুটি থেকে সদ্য কাজে যোগ দিয়েছেন। তাই বিশেষ কিছু বলতে পারবেন না।
পুলিশের ভূমিকায় প্রশ্ন রয়েছে আরও। গত কয়েক মাসে প্রতিষেধক-দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে লালবাজারে। কোথাও অনলাইনে প্রতিষেধকের খোঁজ করতে গিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। কোথাও আবার অভিযোগ, প্রতিষেধক প্রদান সংস্থার নাম করে বাড়ি গিয়ে বয়স্ক দম্পতির থেকে নথিপত্র নিয়ে তাঁদের নামে কোটি টাকার ঋণের আবেদন করে দেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযুক্তেরা অধরা। পুলিশের গাফিলতি প্রসঙ্গে লালবাজারের কেউই মন্তব্য করতে চাননি। যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) জানিয়েছেন, ঘটনার তদন্তভার নিয়েছে গোয়েন্দা বিভাগ। সব খতিয়ে দেখা হবে।
এ দিন বাগড়ি মার্কেটে খোঁজ করে প্রতিষেধক বিক্রির তেমন কোনও সূত্র মেলেনি। বড়বাজারের ‘বেঙ্গল কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি শঙ্খ রায়চৌধুরী বলেন, “খোলা বাজারে প্রতিষেধক বিক্রি হয় না। আমরা কোভিশিল্ড, কোভ্যাক্সিন বিক্রির অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু ছাড়পত্র মেলেনি। তবু অসাধু পদ্ধতিতে যদি কিছু হয়ে থাকে, পুলিশ তদন্ত করুক।’’ বাগড়ি মার্কেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আশুতোষ সিংহের দাবি, “ইচ্ছে করে বদনাম করা হচ্ছে। আমরা প্রতিষেধক কেনাবেচা করলে কর্মীদের নিয়ে গিয়ে আর জি কর হাসপাতাল থেকে প্রতিষেধক দেওয়াতে হত না। এক দুর্নীতিগ্রস্তের ভুয়ো দাবি নিয়ে অকারণে হইচই হচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy