প্রতীক্ষা: প্রতিষেধক নিতে সকাল থেকে লাইনে প্রবীণেরা। সোমবার, এম আর বাঙুর হাসপাতালে। নিজস্ব চিত্র।
‘মৃত্যুহার কম, তাই চিন্তার কিছু নেই।’— এই মানসিকতা দেখা যাচ্ছে জনগোষ্ঠীর একাংশের মধ্যে। আর সেটাই সাম্প্রতিক করোনা বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের বক্তব্য, বর্তমানে দৈনিক সংক্রমিতের সংখ্যা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে মৃত্যুহার কম না বেশি তা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। কারণ, পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, অফিসের সহকর্মী-পরিচিতের মধ্যে কেউ না কেউ সংক্রমিত হচ্ছেন রোজ। আর এই সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। যা আদতে সামাজিক স্থিতি টলিয়ে দিচ্ছে।
এক ভাইরোলজিস্টের কথায়, ‘‘প্রতিদিন হয়তো পরিচিত-বৃত্তের মধ্যে কারও না কারও সংক্রমিত হওয়ার খবর আসছে। সংক্রমণের মাত্রা যা-ই হোক, এই যে পরিচিতেরা অসুস্থ হচ্ছেন, সেটা একটা নিরাপত্তাহীনতার কাজ করছে অনেকের মধ্যে।’’ কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে জনগোষ্ঠীর একটা অংশ করোনায় মৃত্যুহার কম, এই ধারণার বশবর্তী হয়ে বেপরোয়া আচরণ করছেন বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা।
পরিসংখ্যান বলছে, সোমবার সারা বিশ্বে ‘ক্লোজড কেসেস’ (সংক্রামক রোগীদের মধ্যে যাঁরা মারা গিয়েছেন অথবা সুস্থ হয়ে উঠেছেন, অর্থাৎ নির্দিষ্ট ফলাফলে পৌঁছনো গিয়েছে)-এর সংখ্যা ছিল প্রায় ১২ কোটি ৩৮ লক্ষ। মৃত্যুহার ২ শতাংশ। ভারতে এই হার ১.১৯ শতাংশ। এ দেশে প্রতি ১০ লক্ষ জনসংখ্যায় কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ১২৯। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ-এর প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল নির্মল গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, মৃত্যুহার কম না বেশি, তা কাটাছেঁড়া করার সময় এটা নয়। কারণ, দৈনিক মৃতের সংখ্যা যদি দেখা যায়, তা হলে সেটা হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। নির্মলবাবুর কথায়, ‘‘তা-ও এটা মনে রাখতে হবে, রিপোর্টেড কেসের ভিত্তিতে এই মৃত্যুহার বলা হচ্ছে। কিন্তু অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেও তাঁদের কোভিড পরীক্ষা না হওয়ায় সেগুলি কোভিড-মৃত্যু হিসেবে গণ্য হচ্ছে না।’’
বিশেষজ্ঞেরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যের উল্লেখ করে জানাচ্ছেন, ঠিক এক বছর আগে অর্থাৎ, ২০২০ সালের ১৯ এপ্রিল দেশে মৃতের সংখ্যা ছিল ২৭। সেই বছরেরই ১৭ জুন দেশে মৃতের সংখ্যা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছয়—২০০৩ জনে। তার পরে দৈনিক মৃতের নিরিখে সর্বোচ্চ ছিল ১৬ সেপ্টেম্বর। সেদিন দেশে কোভিডে-মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১২৯০-তে। যা চলতি বছরের শুরুতে হঠাৎই নিম্নমুখী হয়। গত পয়লা জানুয়ারি দেশে কোভিড-মৃতের সংখ্যা ছিল ২৫৬। পয়লা ফেব্রুয়ারি ও পয়লা মার্চে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১১৮ এবং ১০৬। যা ফের ঊর্ধ্বমুখী হয় মার্চের শেষ থেকে। ৩১ মার্চ দেশে কোভিডে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫৪-য়। আর এপ্রিলের শুরু থেকে করোনা মৃত্যুর ঊর্ধ্বমুখী লেখচিত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। যেখানে সোমবার মৃতের সংখ্যা ছিল ১৬১৯!
যার পরিপ্রেক্ষিতে মাইক্রোবায়োলজিস্ট সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট এ এম দেশমুখ বলছেন, ‘‘মৃত্যুহার কম হলেও দৈনিক মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। এমনকি, আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি স্বাস্থ্য পরিষেবার উপরে অসম্ভব চাপ সৃষ্টি করছে। এই বিষয়গুলো যথেষ্ট উদ্বেগের। ফলে মৃত্যুহার কমের কারণে আত্মসন্তুষ্টিই বিপদ ডেকে আনছে!’’
কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভাবতে শুরু করেছেন, ‘করোনা হলে হবে। ঠিক সামলে নেব। বেশির ভাগই তো সুস্থ হয়ে উঠছেন।’ আর এই মানসিকতার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে রাস্তাঘাটে, বাসে-ট্রেনে যাতায়াতের সময়ে। যেখানে করোনা-বিধি মানার ন্যূনতম কোনও চেষ্টা নেই। নিয়মরক্ষার মাস্ক পরলেও কোথাও দূরত্ব-বিধি মানা হচ্ছে না। আবার মাস্ক যে ভাবে পরা হচ্ছে, তা না-পরারই সমান। অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ-এর প্রাক্তন অধিকর্তা অরুণাভ মজুমদার বলছেন, ‘‘কোভিডে মৃত্যুহার কত, সেটা এখন প্রাসঙ্গিক নয়। কারণ, প্রতিনিয়ত চেনা-পরিচিতদের মধ্যে কেউ না কেউ সংক্রমিত হয়েছেন বলে খবর আসছে। ফলে সামগ্রিক ভাবে একটা সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy