বর্ম: করোনা পরিস্থিতিতে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের অন্যতম ভরসা পিপিই। নিজস্ব চিত্র
রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে বার বারই চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনা সংক্রমিত হচ্ছেন। চিকিৎসকদের একটি বড় অংশের মতে, এই সংক্রমণের অন্যতম কারণ পিপিই পরায় কোনও ভুলত্রুটি। একটানা চিকিৎসা করতে করতে মানসিক ও শারীরিক ধকলের মধ্যে তা ঠিক ভাবে পরা হল কি না, অনেক সময়েই তা খেয়াল রাখা যায় না।
এই পরিস্থিতিতে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ‘বন্ধু-ব্যবস্থা’-কে উৎসাহিত করার জন্য দেশের কোভিড ও নন-কোভিড চিকিৎসা কেন্দ্রকে নির্দেশ দিচ্ছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। যদিও গত মে মাসেও এই ‘বন্ধু-ব্যবস্থা’ (বাডি সিস্টেম) চালু করতে বলেছিল মন্ত্রক। বিষয়টি নিয়ে তখন চর্চাও হয়েছিল। খুব একটা কাজ হয়নি। ফের সেই ব্যবস্থার উপরেই গুরুত্ব দিচ্ছে মন্ত্রক।
এই ব্যবস্থায় দু’জন বা তার বেশি সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী ছোট-ছোট দল তৈরি করবেন। সেই দলের প্রত্যেকের যাতে স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে, তা একে-অপরকে দেখতে হবে। তাঁরা যাতে ঠিক ভাবে পিপিই পরেন এবং খোলেন, এই ব্যবস্থায় তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। পিপিই পরার ক্ষেত্রে কোথাও সুরক্ষা-বিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে কি না, সেটা এক জন অন্য জনেরটা দেখবেন। একে-অপরের ‘হ্যান্ড হাইজ়িন’-এর উপরেও খেয়াল রাখতে বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, ‘‘কোভিড বা নন-কোভিড, যে চিকিৎসা কেন্দ্রই হোক না কেন, স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে বাডি সিস্টেম গড়ে তোলা সুনিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।’’
মেরিয়াম-ওয়েবস্টারের অভিধান অনুযায়ী, ‘বাডি সিস্টেম’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল একশো বছর আগে, ১৯২০ সালে। বর্তমানে যা পৃথক তাৎপর্যে ব্যবহার হচ্ছে! যদিও ‘বাডি’ শব্দটি তার অনেক আগে থেকেই ইংরেজি শব্দ ভাণ্ডারে ঢুকে পড়েছে বলে জানাচ্ছে অক্সফোর্ড অভিধান। ‘করপাস অব হিস্টোরিক্যাল আমেরিকান ইংলিশ’ আবার বলছে, প্রথম বার ‘বাডি সিস্টেম’ শব্দটি কোনও ফিকশনে ব্যবহৃত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। ‘বাডি সিস্টেম’ ব্যবস্থাটি সামরিক বাহিনী-সহ একাধিক ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত হলেও সাম্প্রতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ আলাদা অর্থে ব্যবহার হচ্ছে।
মনোবিদদের একটি অংশের মতে, প্রতিদিন যে অপরিসীম চাপ নিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ করতে হচ্ছে, তাতে নিজের সুরক্ষার দিকটি অনেক সময়েই খেয়াল রাখতে পারছেন না তাঁরা। কিংস কলেজ লন্ডনের ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি, সাইকোলজি অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সে’-এর এমেরিটাস প্রফেসর দীনেশ ভুগরার কথায়, ‘‘প্রতিদিন কাজের চাপ স্বাস্থ্যকর্মীদের উপরে গুরুতর প্রভাব ফেলছে। এই অবস্থায় স্বাস্থ্যকর্মীদেরই নিজেদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখতে হবে। শুধু পারস্পরিক সুরক্ষাই নয়, সবাই যাতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম পান, তাও সুনিশ্চিত করতে হবে।’’
শহরের অন্যতম কোভিড চিকিৎসা কেন্দ্র বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের অধ্যক্ষ অণিমা হালদার জানাচ্ছেন, কোভিডের বিরুদ্ধে যেখানে প্রতিদিন আক্ষরিক অর্থে লড়াই করতে হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীদের, সেখানে কোনও বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে যদি পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা, বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়, সে ক্ষেত্রে আখেরে লাভ সবারই। অণিমাদেবীর কথায়, ‘‘এই সময়ে যখন সব কিছুই অনিশ্চিত, সেখানে স্বাস্থ্যকর্মীদের একে-অপরের প্রতি খেয়াল রাখাটা খুবই দরকার। এই ব্যবস্থায় সেটাই সম্ভব হচ্ছে।’’
নন-কোভিড চিকিৎসা কেন্দ্র যেমন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কর্তাদের অবশ্য বক্তব্য, কোভিড সংক্রমণে আলাদা করে ‘বাডি সিস্টেম’-এর উপরে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বটে, কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জাজনিত রোগের চিকিৎসা করার সময়ে বা সারি (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন্স) ইউনিটে সাধারণ ভাবেই পিপিই-র উপরে জোর দেওয়া হয়। কলেজের অধ্যক্ষ শুদ্ধোদন বটব্যাল জানাচ্ছেন, মার্চে সংক্রমণ তখনও সে ভাবে ছড়াতে শুরু করেনি, সেই সময়েই পিপিই যাতে ঠিক মতো পরা এবং খোলা হয় তা হাতেকলমে দেখানো হয়েছিল স্বাস্থ্যকর্মীদের। প্রতিটি ইউনিটে বিশেষ ক্ষেত্রে যাতে ঠিক মতো পিপিই পরা হয়, তার উপরে নজর রাখা হয়। শুদ্ধোদনবাবুর কথায়, ‘‘শুধু পিপিই-ই নয়, প্রত্যেকে ঠিক মতো গ্লাভস, মাস্ক পরেছেন কি না, তা দেখার জন্য আলাদা সুপারভাইজ়ারও রয়েছেন।’’
ফলে কোভিড-যুদ্ধে একলা চলো নয়, ‘বাড়িয়ে দাও তোমার হাত’-এই ভরসা করতে চাইছে চিকিৎসক মহল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy