অবহেলিত: মানিকতলা বাজারের ঘড়ি মিনার, নিউ মার্কেটের ঘড়ি মিনার ও ক্রিক রো-য়ে রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিকের বাড়ি । ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
অতীতের নির্মাণশৈলী অক্ষুণ্ণ রাখতে ইটের উপরে দেওয়া চুনের প্রলেপের সঙ্গে মেশানো হয়েছিল চাক্কিতে পেষা মেথি, গুড়, বেল, নদীপাড়ের বালি, সুরকি-সহ একাধিক সামগ্রী। তার পরেই জীবন্ত হয়ে উঠেছিল দ্বিশতবর্ষ ছুঁতে চলা পুরনো কাঠামো!
‘‘১৮৩৩ সালে ইটালীয় শৈলীর জানলা, ঢালাই লোহার অলঙ্কৃত গেট-সহ এই অভূতপূর্ব ভবনটি নির্মিত হয়েছিল। তার ১৮৫ বছর পরে, অর্থাৎ ২০১৮ সালে আমূল সংস্কারের সিদ্ধান্তের সময়ে সব থেকে আগে ভবনের কাঠামোগত নির্মাণশৈলীর পদ্ধতি ও সেই সময়ের নির্মাণ সামগ্রীকে বোঝার প্রয়োজন ছিল।’’ ডালহৌসি স্কোয়ারের কারেন্সি বিল্ডিংয়ের সংস্কার নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের (আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া বা এএসআই) কলকাতা সার্কলের সুপারিন্টেন্ডিং আর্কিয়োলজিস্ট শুভ মজুমদার। সেই মতোই শুরু হয়েছিল অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সেতুবন্ধনের কর্মযজ্ঞ।
কারেন্সি বিল্ডিংয়ের প্রধান নির্মাণ সামগ্রী ইট-চুন-সুরকির অনুপাত বোঝার জন্য প্রথমে আতশকাচের মাধ্যমে নির্মাণ সামগ্রীর পরীক্ষা, তার পরে সিলিন্ডার পরীক্ষার মাধ্যমে (যেখানে সিলিন্ডারে জল নিয়ে তার মধ্যে চুনচূর্ণ মিশিয়ে ঝাঁকানো হয়, যাতে চূর্ণের সূক্ষ্ম ও ভারী উপাদানগুলি যথাক্রমে জলের উপরিভাগে ও নীচে জমা হয়) সংশ্লিষ্ট সামগ্রীর আকৃতি এবং সব শেষে পরীক্ষাগারে মিশ্রিত উপাদানগুলির সঠিক অনুপাত বার করা হয়। এই রকম আরও হাজারো পদ্ধতি পেরিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছিল সংস্কার। শহরের অন্য একাধিক ঐতিহ্যশালী ভবনের সঙ্গে গত বছর এই ভবনেরও উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কলকাতা তথা বাংলার ঐতিহ্যকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়ার কথাও শোনা গিয়েছিল তাঁর মুখে। যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার বিদ্বজ্জনেদের একাংশ আবার বলেছিলেন, মোদী মোটেই কলকাতার ঐতিহ্যের মুখপাত্র নন! সূত্রপাত হয়েছিল ঐতিহ্য নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের ‘দ্বৈরথ’। যা ইউনেস্কোর আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকায় দুর্গাপুজোর স্বীকৃতি পাওয়ার পরেও অব্যাহত।
আর এখানেই আক্ষেপ ঐতিহ্য সংরক্ষণবিদদের। তাঁরা বলছেন, ধরা যাক, ইউনেস্কোর স্বীকৃতির কারণে দুর্গাপুজোর সময়ে শহরে বিদেশি পর্যটকদের ঢল নামল। কিন্তু কলকাতায় এসে কী দেখবেন তাঁরা? ভারতীয় জাদুঘর, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-সহ অতি পরিচিত বিশ্বনন্দিত পর্যটনকেন্দ্রের বাইরে যে অগুনতি ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের মণিমুক্তো ছড়িয়ে রয়েছে সারা শহর জুড়ে, তা তাঁদের দেখানো যাবে তো? রাজনৈতিক তরজার বাইরে বেরিয়ে এসে দেখানো যাবে তো উত্তর, মধ্য কলকাতার একের পর এক ঐতিহ্যবাহী বাড়ির ভগ্নপ্রায় দুরবস্থা? বা হারিয়ে যাওয়া স্থাপত্যশৈলীর খসে পড়া চাঙড়, দেওয়ালে বটগাছ গজানো হতশ্রী দশা?
অথচ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনস্থ ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্ট’-এর ‘রেসিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার’-এর বিভাগীয় প্রধান চন্দন ঘোষ বলছেন, ‘‘বর্তমান প্রযুক্তির মাধ্যমে একদম ভাঙার প্রয়োজন না হলে শতাধিক বছরের পুরনো, দেওয়ালে বটগাছ গজানো বাড়িরও সংরক্ষণ সম্ভব।’’ কিন্তু সেই সংরক্ষণের বিজ্ঞান ও বাস্তবসম্মত চেষ্টাই শুরু হয়নি বলে জানাচ্ছেন ঐতিহ্য সংরক্ষণবিদেরা। কলকাতা পুরসভার হেরিটেজ কমিটির সদস্য হিমাদ্রি গুহ বলছেন, ‘‘ইউনেস্কোর স্বীকৃতির ফলে শহরের ঐতিহ্যবাহী বাড়ি, ভবনের হাল ফিরবে, তা
আশা না করাই ভাল। অথচ পুজো-উন্মাদনার সিকিভাগও জুটলে বেঁচে যেত শহরের ঐতিহ্য।’’
‘‘শহরের প্রতিটি বাড়ির ইটে যে ইতিহাস, গল্প লুকিয়ে রয়েছে, তা বিশ্বের আর কোত্থাও নেই। একটু পরিকল্পনা ও উদ্যোগ থাকলেই ঐতিহ্যের বিপণন সম্ভব হত’’— বলছেন বর্ষীয়ান কলকাতা-গবেষক হরিপদ ভৌমিক। তা তো হচ্ছেই না। উল্টে বাড়ির মালিকদের একাংশ রীতিমতো ক্ষুব্ধ হেরিটেজ মর্যাদা নিয়ে। কারণ, পূর্বপুরুষের করা বাড়ি স্থাপত্যশৈলী, ঐতিহাসিক বা অন্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কারণে পরবর্তীকালে হেরিটেজ ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও শরিকি ঝামেলায়, কোথাও আর্থিক সঙ্গতির অভাবে বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ হয়ে উঠছে না। হেরিটেজ মর্যাদার কারণে বাড়িটি বিক্রি বা ভেঙে নতুন ভাবে নির্মাণও করা যাচ্ছে না। তাই সংশ্লিষ্ট মালিকেরা গোপনে বাড়িটি প্রোমোটারদের হাতে তুলে দিচ্ছেন বলে জানাচ্ছেন সংরক্ষণবিদেরা। বা পুরসভার বিরুদ্ধে মামলা করছেন।
এই পরিস্থিতিতে হেরিটেজ বাড়ির ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রেখে তাকে বিকল্প আয়ের উৎস হিসাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট নীতির প্রয়োজন বলে মনে করছেন অনেকে। তার জন্য প্রয়োজন আইন সংশোধনের। অথচ, রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের সদস্য পার্থরঞ্জন দাশের কথায়, ‘‘বর্তমানের দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল হেরিটেজ কমিশন অ্যাক্ট, ২০০১-এর সংশোধনের খসড়া এক বার হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।’’
অথচ ভবন, স্থাপত্যশৈলীর বাইরেও শহরের আনাচে-কানাচে অবহেলায় ঐতিহ্য-স্পর্শ ছড়িয়ে রয়েছে। যেমন হেরিটেজ মর্যাদাপ্রাপ্ত নিউ মার্কেটের ঘড়ি মিনার সাড়ে চার বছর ধরে বন্ধ। ঘড়ির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত, সত্তরোর্ধ্ব স্বপন দত্ত বলছেন, ‘‘হগ মার্কেটের সংস্কারের সূত্রে ঘড়িটি পরিদর্শন করেছি, তা-ও প্রায় পাঁচ মাস হয়ে গেল। তার পরেও ঘড়িটি সারানো নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি।’’ স্থপতি সুবীর বসু আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘শহরের ঐতিহ্যবাহী, নান্দনিক গুরুত্বসম্পন্ন বাড়ির সংরক্ষণের দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই।’’
ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত তো কলকাতা?— প্রশ্ন, সংশয় সেখানেই। কারণ, রাজনৈতিক তরজায় থাকলেও ভোটের বাজারে ঐতিহ্যের তো কোনও দর নেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy